কেবলমাত্র মহাকাব্য ‘ইলিয়াড’ এবং ‘ওডিসি’-তে বলা ঘটনাগুলির বাস্তবতার প্রমাণ খুঁজতেই নয়, পণ্ডিত-গবেষকেরা হোমারের অস্তিত্ব নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন! আদৌ হোমারের অস্তিত্ব ছিল কিনা তা নিয়েই তাঁদের নানা প্রশ্ন আছে। প্রথম সন্দেহ হোমারের জীবন নিয়ে পাওয়া যায় অতি সামান্য কিছু তথ্য। পণ্ডিত-গবেষকেরা বলেন, এই মহান কবির অস্তিত্ব যদি থেকেও থাকে, তাহলেও তাঁরা প্রায় নিশ্চিত যে তিনি এই বিখ্যাত লেখা দুটির একমাত্র লেখক নন।ইতিহাসের জনক হেরোডোটাসের মতে, হোমার সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব নবম শতকের মাঝামাঝি সময়ের। অন্যান্য সূত্র জানাচ্ছে, হোমার ট্রোজান যুদ্ধের কাছাকাছি সময়কার। অন্যদিকে আধুনিক পন্ডিতদের মতে, তিনি ছিলেন খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকের। তবে তাঁকে সাধারণত কিওস দ্বীপে জন্মানো একজন অন্ধ লোক হিসেবে বর্ণনা করা হয়।কিন্তু এই তথ্যগুলি নিয়েও আছে বিতর্ক। তাঁর জীবনী সংক্রান্ত এসব বিভ্রান্তিই এই ধারণার উদ্রেক ঘটায় যে, ইলিয়াড এবং ওডিসি মূলত অনেক কবির মিলিত প্রচেষ্টার ফল কিংবা মুখে মুখে প্রচলিত বিখ্যাত ঘটনাবলী থেকে অনুপ্রাণিত।

হোমারের রচনা থেকেই পণ্ডিত-গবেষকেরা অনুমান করেন, রাজকাহিনী সংবলিত ইলিয়াড ও ওডিসি রচনা করলেও হোমার খুব সম্ভ্রান্ত ঘরে জন্মগ্রহণ করেননি। কারণ দেবদেবী এবং রাজাদের পাশাপাশি তিনি ধীবর, নিঃসঙ্গ, বিধবা এবং কৃষকদের যে ছবি এঁকেছেন তাতে মনে হয়, শেষোক্ত শ্রেণীগুলোর সঙ্গেই তার যোগাযোগ ছিল আত্মিক। ঐতিহাসিক হেরোডোটাস উল্লেখ করেছেন, হোমার শেষ জীবনে অন্ধ হয়ে মারা যান। কিন্তু হোমার যে অন্ধ ছিলেন এ সম্পর্কে বিশেষ কোনো তথ্য-প্রমাণ যাওয়া যায়নি। ভ্যাটিক্যান শহরের মেলাডেলা মিউজিয়ামে রক্ষিত খ্রিস্টপূর্ব চারশত পঞ্চাশ শতাব্দীতে গ্রিকদের আঁকা হোমারের একটি প্রতিকৃতির সন্ধান পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব নবম শতকের মাঝামাঝি সময়ে এশিয়া মাইনরের মধ্যপশ্চিম অঞ্চলের আয়োনিয়ায় মহাকবি হোমারের জন্ম হয়েছিল বলেও ঐতিহাসিকদের মত। কেউ কেউ স্মার্না, আর্গোস, কালোফোন, সাইপ্রাসের সালামিস রোডস, চিওস, এথেন্স প্রভৃতি স্থানকেও হোমারের জন্মভূমি বলে মনে করেন। অনেকে হোমার নামে আদৌ কোনো কবি ছিলেন কি না বলেও সন্দেহ প্রকাশ করেন। কেউ কেউ হোমার নামে সে যুগে মোট ক’জন কবি ছিলেন সেই প্রশ্নও রাখেন। কোনো কোনো গবেষক বলেন, প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ে হোমেরোস-ঐড়সবৎড়ং নামে একজন মহাকবি ছিলেন, যিনি ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’ নামে দুটি মহাকাব্যকে প্রাথমিকভাবে সন্নিবেশিত করেছিলেন।

ইলিয়াড ও ওডিসি রচিত হয়েছিল ট্রয় অভিযান সম্বন্ধীয় কাহিনী একত্র করে। ট্রয় বা ইলিওন বা ইলিয়াম শহরটি ছিল এশিয়া মাইনরের উপকূলে। উঁচু টিলার ওপরে নির্মিত এই নগরের চারদিকে পাথরের প্রাচীর একে দুর্ভেদ্য করে রেখেছিল। বিভিন্ন গ্রিক উপজাতি তাঁদের নিজেদের রাজ্য অধিপতির নেতৃত্বে এই নগর আক্রমণ করার উদ্দেশে অভিযান শুরু করে। গ্রিকরা সমুদ্রতীরের ওপর তাদের কাঠের জাহাজ টেনে নিয়ে গিয়ে শিবির স্থাপন করে ১০ বছর ধরে ট্রয় অবরোধ করে রাখে। ইলিওন বা ইলিয়াম শহরের নামানুসারে কাব্যের নামকরণ করা হয়েছিল ‘ইলিয়াড’। ইলিয়াড রচিত হয়েছিল ট্রয় যুদ্ধের দশ বছরের শেষ একান্ন দিনের ঘটনা অবলম্বনে। একিলিসের ক্রোধ থেকে কাহিনীর শুরু এবং হেক্টর বধে কাহিনীর সমাপ্তি। ইলিয়াডের চব্বিশটি অধ্যায়ের এবং প্রায় ষোল হাজার হেক্সামিটারসম্পন্ন। ট্রয় রাজকুমার প্যারিস কর্তৃক মেনেলাউস পত্নী সুন্দরী হেলেন অপহরণ এবং গ্রিক বাহিনী কর্তৃক হেলেন উদ্ধারের জন্য ট্রয় অভিযান হলো ইলিয়াদের কাহিনীর ভিত্তি।

অন্যদিকে ‘ওডিসি’মহাকাব্য ইলিয়াডের পরিশিষ্ট, ট্রয়য়ুদ্ধ শেষে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনকারীদের মধ্যে পোসাইডনের চক্রান্তে দল ছাড়া বীর ওডিসিউসের কাহিনী। ওডিসিও চব্বিশটি অধ্যায়ে বিভক্ত এবং প্রায় এগারো হাজার লাইনের মধ্যে সমাপ্ত। ট্রয়যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার সময় নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া ইথাকার সম্রাট ওডিসিউসের পত্নী পেনিলোপি একদল পানিপ্রার্থীর কাছে বিব্রত হতে থাকেন। সেই আসহনীয় অবস্থা সহ্য করতে না পেরে তাঁর ছেলে টেলেমেকাস তাঁর বাবার খোজে সমুদ্রযাত্রা করে। কিন্তু দেবী অ্যাথিনির কৃপায় সে জানতে পারে, তাঁর মায়ের পানিপ্রার্থীরা তাঁর বাবাকে হত্যার চক্রান্ত করেছে। সে লুকিয়ে স্বদেশে ফিরে আসে এবং বাবার বিশ্বস্ত বন্ধু ইউমেউসের ঘরে আশ্রয় নেয়।

হোমারের মহাকাব্যে কল্পকাহিনীর পরিমাণ এতো বেশি ছিল, বিশেষজ্ঞরা বহুকাল ধরে ভেবেছেন কাব্যে বর্ণিত ঘটনাবলী সবই কল্পিত। এমনকি অনেকেরই ধারণা ট্রয় নামে কোনো নগরীর অস্তিত্বই ছিল না। কিন্তু হোমারের মহাকাব্যে বর্ণিত ট্রয় নগরী যে পৃথিবীতে ছিল এ নিয়ে এখন আর বিতর্ক নেই। বর্তমানে তুরস্কের উপকূলবর্তী নগরী ছিল হেলেনখ্যাত ট্রয় সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র, এ ব্যাপারে প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবিদরা একমত। এক নারীকে কেন্দ্র করে যুদ্ধে লিপ্ত ট্রয়বাসীরা নিজেরাই নিজেদের সভ্যতাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version