তপন মল্লিক চৌধুরী

দেবদেবীর রূপ ও রঙের ইতিহাস যেমন আশ্চর্যের তেমনই সমৃদ্ধ বাংলার মাটিতে তাঁদের মন্দির এবং সেগুলি ঘিরে গড়ে ওঠা লোকাচার। তেমনই একটি মন্দির রয়েছে হুগলী জেলার রাজবলহাটে। মন্দিরটির আনুমানিক বয়স ৮০০ বছর। যদিও তার গায়ে প্রাচীনত্নের কোনও চিহ্ণ আজ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে আশ্চর্য হতে হবে ওই মন্দিরের বিগ্রহ দেখে। বিগ্রহটির নাম রাজবল্লভী আদতে যা কালী বা দুর্গা-কালী ও সরস্বতীর মিশ্র রূপ। স্থানীয় নাম সাদা কালী। এটি বাংলার একটি ব্যতিক্রমী কালী মূর্তী যার গাত্রবর্ণ সাদা। সাদা কালীর তিনটি চোখ, মাথায় বিরাট মুকুট, কালীর রূপ বিন্দুমাত্র ভীষণা বা উগ্র নয় বরং অতি প্রসন্ন। কালীর বা হাতে সিঁদুরের কৌটো, ডান হাতে ছুরি। কোমড়ে ছোট ছোট কাটা হাতের মালা আর গলায় ঘন্টা মালা।

বাংলায় সাদা কালী কেবলমাত্র হুগলীর রাজবলহাটেই নয় রয়েছে বীরভূম জেলার সিউড়ি শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে অজয়পুর গ্রামে ময়ূরাক্ষী নদীর পাড়ে। তবে অমাবস্যায় নয় এখানে অগ্রহায়ণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতেকালী পুজো হয়আর গায়ের রং সাদা বলেই সবাই এই কালীকে শ্বেত কালী বা সাদা কালী নামেই ডাকে।

বহুদিন আগে অজয়পুরের পাশে ব্রজোরপুর নামে এক গ্রাম ছিল।১৯৭৮ সালের বন্যায়ব্রজোরপুরগ্রাম ভেসে গেলে গ্রামবাসী অজয়পুর গ্রামে আশ্রয় নেয়। ব্রজোরপুর গ্রামে থাকতেন জ্বালাতন নামে এক সাধু, তিনিই এই পুজোর সূচনা করেন।শোনা যায় অমাবস্যায় প্রদীপের আলোতে ঠিক ভাবে পুজো করা যেতনা তাই তিনি পূর্ণিমা তিথিতে এই শ্বেতকালীর পুজো শুরু করেন। জ্বালাতন সাধুর মৃত্যুর পর অজয়পুরের ঋষিকেশ মাহারাও তাঁর বংশধর এই পুজো করে আসছেন।

আমরা কালী মানেই বুঝি ঘোর কৃষ্ণবর্ণা ও উগ্রচণ্ডা রূপ। যার গলায় নরমুণ্ডের মালা, কোমরবন্ধে কাটা হাত এবং নগ্ন রূপের এক ভয়ঙ্করী মূর্তি। কিন্তু কালী রূপ যদি সম্পূর্ণ সাদা হয় আর তাঁরপরণে যদি থাক্র শাড়ি, অনেকটাই ঘরের মেয়ের মতো; তবে তো অবাক হতেই হয়। ঠিক এই রূপের সাদা কালী পুজো হয়পশ্চিম বর্ধমানের কুলটিতে।

কালী বা কালিকা দেবী দূর্গার অন্য একটি রূপ। তার আরেকটি নাম শ্যামা বা আদ্যাশক্তি। প্রধানত শাক্ত সম্প্রদায় কালীপূজা করে থাকে। তন্ত্র অনুসারে কালী দশমহাবিদ্যা-র প্রথম দেবী। শাক্তমতে কালী বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদি কারণ। বাঙালি হিন্দু সমাজে কালীর মাতৃরূপের পুজোই জনপ্রিয়।কালীর বিভিন্ন রূপের মধ্যে শ্মশানকালী ও শ্যামাকালী অনেকটাই অন্যরকম।শ্মশানকালীঘোর কৃষ্ণবর্ণের ও রূপেউগ্রচণ্ডা। অন্যদিকে শ্যামাকালীপুরোপুরি নীল বর্ণের। কিন্তু সকলের থেকে আলাদা হল এই সাদাকালী।কুলটির লালবাজারের একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত ফলহারিণী কালী মন্দির। এই কালী নগ্ন নয়, সাদা পাথরের প্রতিমা। তাঁকে শাড়ি পরিয়ে রাখা হয়। কালীর রূপও উগ্র নয়, আতিসৌম্য।

ফলহারিণী কালী মন্দিরের প্রধান সেবাইত মধুময় ঘোঘের থেকে জানা যায়, , ২০০৫ সালে অর্থাৎ ১৫ বছর আগে তিনি স্বপ্নাদেশ পান। স্বপ্নের নির্দেশ মতো তিনি বাঁকুড়ার শুশুনিয়া পাহাড় থেকেএই সাদা কালী মূর্তিটিনিয়ে এসেছিলেন। তারপর থেকে ওই মূর্তিকেই পুজো করে আসছেন তিনি। পরবর্তী সময়ে এলাকাবাসী এখানে একটি মন্দির তৈরি করেন নিজেদের উদ্যোগে।প্রতি অমাবস্যায় বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়। তবে এই ফলহারিনী কালীর প্রধান পুজো হয় জ্যৈষ্ঠ মাসে। যদিও কালীপুজোর দিন হয় বিশেষ পুজো।

আসমুদ্রহিমাচলশক্তি আরাধনার পীঠস্থান হিসেবে পরিচিত- উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম, সারা দেশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন শক্তিপীঠ৷ এই বাংলায় শক্তি আরাধনা হিসেবে সবাই কালীপুজোকেই বুঝে থাকেন৷ দেবীর পুজোও নানা জায়গায় নানা উপাচারে করা হয়৷ কোথাও শ্মশানকালী, কোথাও ডাকাতকালী, কোথাও কালী পূজিত হন চামুণ্ডা রূপে, কোথাও কালী ভয়ংকরী, কোথাও বামা, কোথাও দক্ষিণা, কোথাও বা বরাভয়া৷ কিন্তু সাদা কালী পুজো বাংলার আর কোথাও হয় বলে এখনও জানা যায় নি।

Share.

1 Comment

  1. suvash talukdar on

    এমন আশ্চর্য কালী রূপের কথা জানা ছিল না। ধন্যবাদ।

Leave A Reply

Exit mobile version