কলকাতা ব্যুরো: চলে গেলেন আপামর বাঙালির ‘ছোটবেলার জাদুকর’ নারায়ণ দেবনাথ। বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর। মঙ্গলবার সকালেই শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটেছিল তাঁর। কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালে সকাল ১০টা ১৫ মিনিট নাগাদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন প্রবীণ শিল্পী। তাঁর প্রয়াণের খবরে মর্মাহত অনুরাগীরা।

নারায়ণ দেবনাথ নামটার এমনই সম্মোহনী ক্ষমতা যে, তা কেবল সাংস্কৃতিক মহলের চৌহদ্দিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ছড়িয়ে পড়েছিল আমজনতার হৃদয়ে। তাঁর মৃত্যু তাই কার্যত বহু বাঙালির ছোটবেলার জৌলুসকেই ম্লান করে দিল এক ধাক্কায়।

গত বছর ২৪ ডিসেম্বর কলকাতার মিন্টো পার্কের বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় প্রবীণ শিল্পীকে। ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিট বিশেষজ্ঞ সমরজিৎ নস্কর-সহ ছ’জনের এই টিম সারাক্ষণ তাঁকে পর্যবেক্ষণে রেখেছিলেন। ১৩ জানুয়ারি প্রবীণ শিল্পীর সঙ্গে হাসপাতালে দেখা করেন মন্ত্রী অরূপ রায়। সেখানেই তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় পদ্মশ্রী সম্মান। হাসপাতালের বিছানায় শয্যাশায়ী অবস্থাতেই তিনি তা গ্রহণ করেন। এদিকে শনিবার রাত ৯.১৫ নাগাদ শিল্পীকে ভেন্টিলেশনে দেওয়া হয়। আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন চিকিৎসকরা। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। 

বিগত শতাব্দীর পাঁচের দশক থেকেই তাঁর আঁকার সঙ্গে পরিচয় বাঙালি পাঠকের। দেব সাহিত্য কুটির থেকে প্রকাশিত ছোটদের বই হোক কিংবা ‘শুকতারা’-র পাতা, তরুণ নারায়ণ দেবনাথের অলঙ্করণের ম্যাজিক তখন থেকেই সবাইকে মুগ্ধ করেছিল। শৈল চক্রবর্তী, প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীদের সঙ্গে রাতারাতি পাঠকের আপনজন হয়ে উঠতে শুরু করেন তিনি।

কিন্তু ছয়ের দশকের গোড়ার দিকে শুকতারার সম্পাদকের অনুরোধে ‘হাঁদা ভোঁদা’-র জন্মলগ্ন থেকেই বোধহয় নারায়ণের সঙ্গে ছোট্ট ছেলেমেয়েদের এক অমোঘ সম্পর্ক সূচিত হয়ে যায়। খানিক পরে আবির্ভাব হয় ‘বাঁটুল দি গ্রেট’-এর। এসে পড়ে ‘নন্টে ফন্টে’, ‘বাহাদুর বেড়াল’-রা। জনপ্রিয়তায় এদের মতো না হলেও ‘শুঁটকি আর মুটকি’, ‘পটলচাঁদ দ্য ম্যাজিশিয়ান’, ‘গোয়েন্দা কৌশিক রায়’-রাও বাঙালি পাঠকের বহু নিরলস দুপুরের সঙ্গী থেকেছে। জনপ্রিয়তা অর্জন করার থেকেও বোধহয় কঠিন সেই জনপ্রিয়তাকে বজায় রাখা। বছরের পর বছর ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে মুগ্ধ করে রেখেছিলেন নারায়ণ দেবনাথ।

গত কয়েক দশকে অনেকটাই বদলে গিয়েছে বাঙালির অন্দরমহল। স্বাভাবিক ভাবেই বদলে গিয়েছে ছোটবেলাও। আজকের শিশুদের কাছে অপশন অনেক বেশি। কার্টুন থেকে শুরু করে রকমারি গেমের আবেদনের মধ্যেও কিন্তু অমলিন রয়ে গিয়েছে বাঁটুল, নন্টে-ফন্টের জাদু। আর এখানেই বোধহয় নারায়ণ দেবনাথের মাস্টারস্ট্রোক। যা চিরসম্মোহিত করে রেখেছে বাংলার শৈশবকে।

এদিন শিল্পীর প্রয়াণে শোকপ্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়।

প্রধানমন্ত্রী টুইটারে লেখেন, শ্রী নারায়ণ দেবনাথ জী তাঁর কাজ, কার্টুন এবং ছবির মাধ্যমে বহু মানুষের জীবন উজ্জ্বল করে তুলেছিলেন। তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত শক্তি তাঁর কর্মকান্ডে প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলি আজীবন জনপ্রিয় হয়ে থাকবে। তাঁর মৃত্যুতে ব্যথিত। তাঁর পরিবার ও ভক্তদের প্রতি সমবেদনা জানাই। ওম শান্তি।

টুইটারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেন, প্রখ্যাত সাহিত্যিক, চিত্রকর, কার্টুনিস্ট এবং শিশুসাহিত্যের জগতে অমর কিছু চরিত্রের স্রষ্টা নারায়ণ দেবনাথের প্রয়াণের খবর অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তিনি ‘বাঁটুল দি গ্রেট’, ‘হাঁদা ভোঁদা’, ‘নন্টে ফন্টে’র মতো চরিত্রদের সৃষ্টি করেছেন, আর তা আমাদের হৃদয়ে যুগ যুগ ধরে রয়ে যাবে।

অন্যদিকে অসুস্থ নারায়ণ দেবনাথকে দেখতে গিয়েছিলেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়। সেই ভিডিও শেয়ার করে তিনি জানান, পদ্মশ্রী নারায়ণ দেবনাথের প্রয়াণের খবর অত্যন্ত দুঃখজনক। সাহিত্য এবং কমিকসের জগতের অপূরণীয় ক্ষতি।

নারায়ণ দেবনাথের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন রাজ্যপাল। 

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version