টানাপোড়েনের দিনগুলিতে উত্তর কলকাতার একটি দোকানে বাসনপত্র ধোয়ার কাজ করেছেন, তারপর সার্কাসে জোকার হিসেবেও কিছুদিন।তাঁর কাকা কাজ করতেন স্টার থিয়েটারের ব্যাকগ্রাউন্ড সংগীতের দলে। কাকার সঙ্গে থিয়েটারে যাতায়াত করতে করতে থিয়েটারের সঙ্গে প্রেম-ভালোবাসা। একদিন স্টার থিয়েটারের অপরেশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নজরে পড়ে শুরু করলেন ট্রেনি আর্টিস্ট হিসেবে। অভিনয়ের পাশাপাশি সমানভাবে গানে, তবলায়, পাখোয়াজে পারদর্শী ছিলেন। ‘দুর্গেশনন্দিনী’ নাটকে মঞ্চ জীবন শুরু। একে একে মনমোহন থিয়েটার, মিনার্ভা, রংমহলে প্রায় ৪২টি প্রযোজনায় অভিনয় করেছেন। থিয়েটার থেকেই ‘পুনর্জন্ম’ ছবিতে সুযোগ পেয়েছিলেন।এরপর ‘শচীদুলাল’, ‘মনোময়ী গার্লস স্কুল’, ‘শঙ্খ সিন্দুর’, ‘কবি’, ‘পথের পাঁচালী’, ‘পরশ পাথর’, ‘মৃতের মর্ত্যে আগমন’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’।
ছোট চরিত্র কিন্তু অভিনেতা হিসেবে সাক্ষর রেখে গিয়েছেন। কখনো মেসমালিক, কোথাও সরাইখানার মালিক, নায়ক কিংবা খলনায়ক নন, তথাকথিত ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করেও স্বকীয়তা বজায় রেখেছেন তিনি।দেখতেও তথাকথিত নায়কের মতো নন। সুদর্শনও বলা যাবে না। বড় বড় চোখ, টাক মাথা, অবিন্যস্ত দাঁত আর ভুঁড়িওলা এই অভিনেতাকে একমাত্র সত্যজিৎ রায়ই বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁকে না পেলে সত্যজিৎ রায় যে ‘পরশপাথর’ বানাতে পারতেন না, এটা তিনি তাঁর শেষ জীবনেও বলেছিলেন, ‘তুলসী চক্রবর্তীর মতো অভিনেতার কদর এই পোড়া দেশে কেউ করবে না, কিন্তু তিনি যদি আমেরিকাতে জন্মাতেন, নির্ঘাত অস্কার পেতেন।’
নির্মল দে পরিচালিত ‘সাড়ে ৭৪’সে সময় টানা আট সপ্তাহ বক্স অফিসে চলেছিল। সত্যজিৎ রায়ের ‘পরশপাথর’ ছবিতে শুটিংয়ের আগে নায়কের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য পোশাক ডিজাইনার তাঁর পাঞ্জাবির মাপ নিতে আসছে শুনে আপ্লুত হয়ে বলছেন, ‘উফ! এ আমি কখনো ভাবতেও পারিনি!’ শুধুমাত্র অভিনয়ের জন্য নয়, ‘পরশপাথর’ তাঁর জীবনের অন্যতম মাইলফলক এ ছবি নিয়ে নানা গল্পের কারণে। এ ছবিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তুলসী নিয়েছিলেন মাত্র ১৫০০ টাকা। সত্যজিৎ রায় সম্মানী বাড়ানোর কথা বললে তুলসী বলেছিলেন, এর থেকে বেশি নিলে বাকি শিল্পীরা কী দোষ করল! তারপর আর হয়ত কোনো ছবিতেই সুযোগ পাব না।
ছবি বিশ্বাস যিনি কিনা কোনোদিনও শুটিং করার সময় সংলাপ মুখস্থ করতেন না। শুধু একবার চোখ বুলিয়ে নিতেন। কিন্তু সহ-অভিনেতা যেদিন তুলসী চক্রবর্তী থাকতেন, সেদিন ছবি বিশ্বাস বলতেন, কী জানি কী প্যাঁচ তুলসী কষবে!
মহানায়ক উত্তম কুমার বলতেন, ‘তুলসীদার মতো অভিনয় তো কোনোদিনই করতে পারব না, ওনার মতো জীবন্ত হয়ে ওঠা আমার দ্বারা হবে না। ওনাকে প্রণাম জানানোর মতো একটাই পথ আছে; পরিচালক প্রযোজকদের বলে যখনই কাজ পাই, তুলসীদাকে ডেকে নিই। উনি থাকলে সিনটা দারুণভাবে উঠে যায়।’ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, “কেউ যদি দেখাতে পারেন অমুক ছবিতে তুলসী চক্রবর্তী খারাপ অভিনয় করেছেন, তা হলে আমি লক্ষ টাকার বাজি হেরে যাব। … উঁচু দরের সহজাত অভিনয়-ক্ষমতার মালিক ছিলেন তিনি।”আর নিজের সম্পর্কে তুলসী চক্রবর্তী বলতেন, তিনি হলেন রান্নাঘরের হলুদ, যেখানে–সেখানে কাজে লেগে যাই। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘চোখ–কান খোলা রাখি, আর সব ধরনের মানুষ দেখে বেড়াই। চরিত্রমতো যখন যাকে দরকার, তাকে তুলে ধরি। এসব চরিত্র ফুটিয়ে তোলার দরকার হয় নাকি? এসব তোমার–আমার চারপাশে ঘুরছে। যেকোনো একটাকে তুলে এনে নিজের কাঁধে ভর করাও।’
তিনি কমেডিয়ান না অভিনেতা, সে অনেক পরের প্রশ্ন।তিনি একজন দক্ষ অভিনেতা, সে কথা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। বহু ছবির জন্য পারিশ্রমিকও নেন নি। চরিত্র ছোট না বড়, গুরুত্ব আছে না নেই, এসবও ভাবেননি।৩১৬টি বাংলা ও ২৩টিহিন্দি ছবিতে অভিনয় করলেও দারিদ্র্য ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। তবু নিজের বাড়িও দান করেছিলেন এলাকার দরিদ্র পুরোহিতদের জন্য। ছোট্ট দুই কামরার বাড়িতে থাকতেন স্ত্রীকে নিয়ে। উত্তম কুমার, তরুণ কুমারদের ছেলে বলে ডাকতেন নিঃসন্তান তুলসী। মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসার জন্য অর্থ জোগাড় করতে হিমশিম খেয়েছেন। তাঁর মৃত্যুর পর পশ্চিম বাংলার সরকারের পক্ষ থেকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোরও কোনো বন্দোবস্ত ছিল না তখন। তাঁর মৃত্যুর পর স্ত্রী উষারাণী দেবী লোকের বাড়ির দরজায় দরজায় ঘুরেছেন একমুঠো খাবারের জন্য। দারিদ্র্যের কারণে স্বামীর সবকটি মেডেলও বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
1 Comment
আমাদের দেশে মানুষের মূল্যায়ন হয় তিনি মারা যাবার অনেক পরে। সবার ক্ষেত্রে হয়ওনা কোনোদিন।