১৯৯০ সালে লাল কৃষ্ণ আদবানী অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের দাবি নিয়ে রথযাত্রা শুরু করেছিলেন। তাঁর সেই রথযাত্রা বিহারে আটকানো হয় এবং তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। সেই বছরই অযোধ্যায় কর-সেবকদের ওপরে গুলি চলে। উত্তরপ্রদেশ সহ দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সেই পরিস্থিতিতে ১৯৯১ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিমহা রাওয়ের সরকার উপাসনা-স্থল আইনটি সংসদে পাশ করায়। উমা ভারতী-সহ বিজেপির নেতারা ওই আইনটির তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। প্রসঙ্গত, বাবরি মসজিদের পরিসরটি আসলে রামচন্দ্রের জন্মভূমি ছিল কী না তা নিয়ে যখন ভারতের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তুঙ্গে, তখন থেকেই হিন্দুত্ববাদীরা একটা স্লোগান দিত যে ‘অযোধ্যা তো সির্ফ ঝাঁকি হ্যায়, কাশী-মথুরা বাকি হ্যায়’, অর্থাৎ অযোধ্যার রামমন্দির দিয়ে শুরু, এরপরে কাশী বা বেনারসের জ্ঞানবাপী মসজিদ ও মথুরার শাহি ইদগাহ বাকি আছে।
হিন্দুত্ববাদীদের ওই স্লোগান অনুসরণ করেই অযোধ্যা নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট ২০১৯ সালে চূড়ান্ত রায় দেওয়ার পর থেকেই কাশী ও মথুরা নিয়ে হিন্দুত্ববাদীরা মন্দিরের দাবি তুলতে শুরু করেন।তারপর ধীরে ধীরে একাধিক রাজ্যে একই ভাবে মুসলমান স্থাপনাগুলিতে মন্দিরের দাবি ওঠানো হতে থাকে। প্রক্রিয়াটা সব ক্ষেত্রে প্রায় এক। মসজিদ বা দরগাহ আগে মন্দির ছিল- এরকম একটা দাবি তুলে একের পর এক আদালতে মামলা হচ্ছে, সেখান থেকে পুরাতত্ত্ব বিভাগকে দিয়ে জরিপ করানোর নির্দেশ আনা হচ্ছে। বর্তমানে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান এবং কর্ণাটকের মতো একাধিক রাজ্যের ১০টিরও বেশি ধর্মীয় স্থান এবং স্থাপনার মামলা বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। প্রথমে বলতে হয় বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদের কথা। ১৯৯১ সাল থেকে বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদের মামলা চলছে তবে ২০২১ সালে মামলাটি নতুন করে গতি পায়। বিশ্বেশ্বর-এর ভক্তরা এই মামলাটি দায়ের করেছিলেন, এরপর ২০২১ সালে পাঁচজন মহিলা আরেকটি পিটিশন দাখিল করেন। নতুন আবেদনে ওই মহিলারা জ্ঞানবাপী মসজিদে পুজোর অনুমতি চেয়েছিলেন। আবেদনকারীদের দাবি, মুঘল শাসক ঔরঙ্গজেব মন্দির ভেঙে এই মসজিদ তৈরি করেছিলেন। বারাণসী জেলা আদালতের রায়ের পর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে মসজিদের বেসমেন্টে পুজো শুরু হয়েছে। আবার ২০২৩ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট রায় দেয় যে ওই আবেদনগুলি উপাসনা-স্থল আইনের বিরুদ্ধে নয়। এই সমস্ত মামলা এখনও আদালতে বিচারাধীন।
এরপর আসে মথুরার শাহী ইদগাহ মসজিদ প্রসঙ্গ। কেউ কেউ দাবি করেন, মথুরার শাহী ঈদগাহ মসজিদটি কৃষ্ণের জন্মস্থানে নির্মিত। ছ’জন ভক্তের হয়ে ২০২০ সালে মসজিদটি অপসারণের জন্য আবেদন করা হয়। বারাণসীর মামলার মতোই এক্ষেত্রেও এলাহাবাদ হাইকোর্ট বলেছে যে মথুরার পিটিশনগুলি উপাসনা-স্থল আইনের পরিপন্থী নয়। সেখানে জরিপ চালানোর জন্য হাইকোর্ট একজন কমিশনার নিয়োগ করেছিল, তবে সুপ্রিম কোর্ট সেই নির্দেশের ওপরে অন্তবর্তীকালীন স্থগিতাদেশ দিয়েছে।
রাজস্থানের আজমির শরীফ দরগাহ বা সুফি সাধক খাজা মইনুদ্দিন চিশতির দরগাহর নিচে একটি শিব মন্দির আছে বলে দাবি করে আজমিরের স্থানীয় আদালতে মামলা করেছেন একটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ‘হিন্দু সেনা’র জাতীয় সভাপতি বিষ্ণু গুপ্তা। তাঁর আবেদনে পুরাতত্ত্ব বিভাগকে দিয়ে জরিপ করানোর দাবি তুলেছেন।উত্তরপ্রদেশের সম্ভলে জামা মসজিদের মামলাটি সাম্প্রতিক সময়ে খবরের শিরোনামে রয়েছে। আইনজীবী বিষ্ণু শঙ্কর জৈন ২০২৪ সালের নভেম্বরে একটি আবেদনে বলেছিলেন যে শ্রী হরিহর মন্দির ভেঙে সম্ভলের জামা মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল।এর পর আদালত একজন কমিশনার নিয়োগ করে একটি জরিপ চালায়। জরিপের রিপোর্ট নিম্ন আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে।মামলাটির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা হয়েছে। সর্বশেষ শুনানিতে সুপ্রিম কোর্ট বলে, জরিপের রিপোর্ট সিল করে রাখতে হবে এবং হাইকোর্টের অনুমতি ছাড়া এই মামলায় কিছু করা যাবে না।
এছাড়াও কর্ণাটকের ম্যাঙ্গালুরুর জুম্মা মসজিদ, কর্ণাটকের চিকমাগালুরের বাবা বুদানগিরি দরগাহ, মধ্যপ্রদেশের ধারের কামাল মৌলা মসজিদ, উত্তরপ্রদেশের লক্ষ্ণৌতে টিলেওয়ালি মসজিদ, উত্তরপ্রদেশের বাদাউনে শামসি জামা মসজিদ, উত্তরপ্রদেশের জৌনপুরে অটালা মসজিদ এবং শেখ সেলিম চিশতির দরগাহ; ফতেপুর সিক্রি,উত্তরপ্রদেশ- এই স্থাপনাগুলি নিয়েও আদালতে মামলা হয়েছে।একাধিক আপিলের শুনানিতে গত বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে উপাসনা-স্থলগুলি নিয়ে আপাতত নতুন কোনও মামলা করা যাবে না। যতদিন আইনটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দায়ের করা আবেদনগুলির শুনানি চলছে, ততদিন নতুন কোনও মামলা করা উচিত নয় বলে যেমন জানিয়েছে শীর্ষ আদালত, তেমনই তারা নিম্ন আদালতগুলিকে উপাসনা-স্থলের অবস্থা নিয়ে কোনও ধরণের রায় বা নির্দেশ দিতেও নিষেধ করেছে।