আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আর অল্প কিছুদিন বাকি। ইতিমধ্যে সে দেশের অনেকগুলি রাজ্যে দেড় কোটির বেশি ভোটাররা আগাম এবং ডাকযোগে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। বুথ সমীক্ষায় উভয় প্রার্থীর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া গিয়েছে। বলাই বাহুল্য দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিসের মধ্যে লড়াই জমে উঠছে। অন্যদিকে ঘনঘন পরিবর্তন হচ্ছে সমীক্ষার ফলাফল। মাসখানেক আগেও কমলা হ্যারিস প্রায় প্রতিটি সমীক্ষায় ট্রাম্পের তুলনায় ভালো অবস্থানে থাকলেও সাম্প্রতিক পর্যায়ে এসে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকার এই নির্বাচনের ফলাফলে রাজ্যগুলির ফলাফল একটি বড় বিষয় হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে এবার যে ৭টি রাজ্যকে দোদুল্যমান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলিতে দুই প্রার্থীকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হচ্ছে। এছাড়া প্রতিবারের নির্বাচনেই আন্তর্জাতিক কিছু ইস্যু থাকে, যা নির্বাচনের মাঠে প্রভাব ফেলে। এবার সেই ধরনের ইস্যুর মধ্যে রয়েছে দুটি বড় যুদ্ধ ইউক্রেন-রাশিয়া এবং ইসরায়েল ও হামাস-হিজবুল্লাহর মধ্যকার সংঘাত। সম্প্রতি রাজ্যগুলিতে প্রচারের পাশাপাশি দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে আন্তর্জাতিক সংঘাত নিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প কমলা হ্যারিসের চেয়ে এগিয়ে আছেন বলে ধারণা করা যাচ্ছে। নির্বাচিত হলে সেই সব যুদ্ধ নিষ্পত্তির বিষয়ে ট্রাম্পের বক্তব্য ভোটারদের কাছে টানছে।
অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ডেপুটি হওয়ার কারণে বাইডেন প্রশাসনের ভূমিকা কমলা হ্যারিসকে বহন করতে হচ্ছে। সেদিক দিয়ে বিগত নির্বাচনে জো বাইডেন মার্কিন মুসলিম ভোটারদের যেভাবে নিজের পক্ষে টানতে পেরেছিলেন, এবার কমলার জন্য তা খুব কঠিন হবে বলে সাম্প্রতিক সমীক্ষায় উঠে এসেছে। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ইউক্রেন-রাশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে বাইডেন প্রশাসনের ভূমিকাকে নেতিবাচক হিসেবে দেখা আমেরিকার ভোটারদের মধ্যে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সেটা যে খুব একটা প্রভাব হিসেবে কাজ করবে সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। বাইডেন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে পশ্চিমের শক্তিগুলিকে একত্রিত করতে সক্ষম হয়েছেন এবং রুশ আধিপত্যকে খর্ব করতে এখন পর্যন্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কমলা হ্যারিস তার প্রশাসনে কাজ করছেন। সেই সূত্রে বলা যায় নির্বাচিত হলে তিনি বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিকতাকেই অক্ষুণ্ন রাখবেন। অবশ্য এখন মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা নিয়ে আমেরিকার সমাজে একধরনের অসন্তোষ বিরাজ করলেও ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচার থেকে যা বোঝা যাচ্ছে তা হল বাইডেন প্রশাসনে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলির পরিবর্তে তাঁর দিক থেকে স্পষ্টভাবে কোনো বক্তব্য নেই। তার মানে দাঁড়াচ্ছে আগামী দিনে যে প্রশাসনই আসুক না কেন আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে না।
স্বভাবতই ভোটারদের মনে এই প্রশ্ন আসতেই পারে যে ৬০ বছর বয়সী কমলা না ৭৮ বছর বয়সী ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে কে বেশি উপযুক্ত আমেরিকায়। এবারের নির্বাচনে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটি হল যখন নির্ধারিত ছিল বাইডেন-ট্রাম্প প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যাচ্ছেন, তখন বাইডেনের বয়স এবং শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্য নিয়ে যেধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছিল, এখন সেটা মোকাবিলা করতে হচ্ছে ট্রাম্পকে। কমলা হ্যারিস ইতিমধ্যে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করলেও তার বিভিন্ন বক্তব্যে তিনি ট্রাম্পকে উদ্দেশ্য করে একই কাজটি করতে বললেও ট্রাম্প শিবির থেকে এর জবাব পাওয়া যায়নি। স্বভাবতই ভোটারদের মনে এই প্রশ্ন আসতে পারে যে ৬০ বছর বয়সী কমলা নাকি ৭৮ বছর বয়সী ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে কে বেশি উপযুক্ত।
নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, দুই প্রার্থীর প্রচারে মুসলিম, ল্যাটিন, আদিবাসী এবং অভিবাসী ইস্যু গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার সেই পুরোনো এবং পরিচিত স্লোগান ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ নিয়ে অভিবাসনবিরোধী প্রচারকে উপরে রাখছেন। কমলা হ্যারিস সে তুলনায় অনেকটাই উদার মনোভাব প্রদর্শন করছেন। তবে একজন আফ্রো-এশিয়ান আমেরিকান হিসেবে সংখ্যালঘুদের তিনি যে কাছে টানতে পারবেন এটা অনেকটাই নিশ্চিতভাবে বলা যায়। তবে আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে সমীক্ষার বিষয়টি খুব আগ্রহ জাগায়। যদিও অতীতের অভিজ্ঞতায় সমীক্ষার ফলাফল সবসময় সঠিক তথ্য দেয় না এমন নজিরও দেখা গিয়েছে, বিশেষ করে ২০১৬ সালের নির্বাচনের বিষয়টি এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, যেখানে বেশিরভাগ সমীক্ষায় হিলারিকে এগিয়ে রাখা হলেও এবং মোট প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধানে হিলারি ক্লিনটন এগিয়ে থাকলেও নাটকীয়ভাবে ইলেক্টোরাল কলেজের হিসাব নিকাশের জেরে তিনি ট্রাম্পের কাছে পরাজিত হন।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বাইডেনের জায়গায় কমলা হ্যারিস প্রার্থী হিসেবে মাঠে নামার পর থেকেই সমীক্ষায় কমলা স্পষ্টভাবে এগিয়ে থাকলেও উপরে উল্লিখিত সমীকরণের জেরে নির্বাচনটি প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। একমাস আগেও বিভিন্ন সমীক্ষায় টানটান উত্তেজনাপূর্ণ সাতটি রাজ্যের মধ্যে ৫টিতেই ট্রাম্প এগিয়ে থাকলেও সম্প্রতি দুজনেই সমান অবস্থানে রয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। এর কারণ হিসেবে আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে দুজনেই এই মুহূর্তে এই রাজ্যগুলির দিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছেন। আমেরিকার ভোটাররা প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প এবং বাইডেন দুজনকেই দেখেছেন। সেক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে ভোটারদের নতুন করে ভাবার কোনো অবকাশ নেই। তাঁর চার বছরে ৩ বার দেশের পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী পরিবর্তন করেছেন। সবচেয়ে ঘৃণ্য যে কাজটি করেছেন, তা হল ২০২০ সালের নির্বাচনের ফলাফলকে প্রত্যাখ্যান করে ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে তার সমর্থকদের দিয়ে ওয়াশিংটনের ক্যাপিটাল হিলে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছেন। সবকিছুই এই নির্বাচনে প্রভাব পড়বে। এই বিষয়গুলো প্রথম প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কে জো বাইডেন তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন, যা ট্রাম্পকে স্পষ্টতই এগিয়ে রেখেছিল। তবে ট্রাম্পের তুলনায় কমলা হ্যারিসের তুলনামূলক গ্রহণযোগ্যতা এবং তারুণ্য, মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি এবং অশ্বেতাঙ্গ হিসেবে কৃষ্ণাঙ্গ এবং সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সমর্থন লাভের সম্ভাবনা ভোটের সার্বিক অবস্থাকে পাল্টে দিতে পারে।