কলকাতা ব্যুরো: ফেসবুকে রাজ্য সরকারের সমালোচনা করে বিতর্কিত পোস্ট করায় দিল্লির এক মহিলাকে কলকাতা পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সমন পাঠানো হয় সুপ্রিমকোর্টের রোষের মুখে পড়ল। ওই মহিলা লকডাউন এর মধ্যে কলকাতা রাজাবাজার এলাকার একটি ভিড়ের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে রাজ্য সরকারকে সেখানে প্রশাসন আছে কিনা এই প্রশ্ন তুলে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিলেন।
আর তাতেই ওই মহিলার বিরুদ্ধে এফআইআর করে তাকে সমন পাঠায় কলকাতা পুলিশ। বুধবার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় ও বিচারপতি ইন্দিরা ব্যানার্জীর ডিভিশন বেঞ্চে মামলা ওঠে। আদালতের প্রশ্ন, একজন সাধারণ নাগরিককে এমন একটি ফেসবুকে পোস্ট করার জন্য কি এভাবে ডাকা যায়! এটা একটা ভয়ঙ্কর প্রবণতা পুলিশের। যার বিরুদ্ধে কোর্ট পদক্ষেপ করতে বাধ্য হবে। এমন চলতে থাকলে কোর্টকেই নাগরিকের বাক স্বাধীনতা মৌলিক অধিকার অধিকার রক্ষা করতে পদক্ষেপ করতে হবে।
এইটুকুতেই থেমে থাকেনি দেশের শীর্ষ আদালত। রাজ্য সরকারের আইনজীবিকে সুপ্রিম কোর্টের প্রশ্ন, যদি ধরা যায় একজন মানুষ, এমন কিছু লিখলেন সরকারের বিরুদ্ধে, যিনি অন্য দেশে বসবাস করেন, তাহলেও কি তাকে কলকাতা বা চন্ডিগড় অথবা মনিপুরের পুলিশ এভাবেই ডেকে এনে শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করবে। এটা একটা ভয়ঙ্কর প্রবণতা বলে মনে করে সুপ্রিম কোর্ট। আদালতের সতর্কতা, মাথায় রাখবেন এটা স্বাধীন দেশ।
রো শ নী বিশ্বাস নামে দিল্লির ওই মহিলা এর আগে কলকাতা পুলিশের দায়ের করা এফআইআর খারিজের দাবিতে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন। ২৯ সেপ্টেম্বর কলকাতা হাইকোর্ট তাকে পুলিশের সামনে হাজির হওয়ার ও সহযোগিতা করার নির্দেশ দেন। তদন্তকারী অফিসারকে ভিডিও কনফারেন্সে অথবা মহিলার সামনে কথা বলার অনুমতি দেয় হাইকোর্ট। হাই কোর্টের ওই নির্দেশে সুপ্রিম কোর্ট স্থগিতাদেশ দিয়েছে।
লকডাউনের মধ্যে ১৩ মে তার ফেসবুকে পোস্ট করা রাজাবাজারের ওই ছবি এবং সরকারকে রাজাবাজারে প্রশাসন আছে কিনা এই নিয়ে প্রশ্ন করায় বালিগঞ্জ থানা তার বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করে। ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করা, ধর্মীয় অনুভূতিকে অসম্মান করা, শান্তি বিঘ্নিত করা, জনতাকে অসম্মান করা সহ একাধিক ধারায় তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। একই সঙ্গে তথ্য প্রযুক্তি আইন এবং বিপর্যয় মোকাবিলা আইনে মামলা হয় ওই মহিলার বিরুদ্ধে।
গত ৫ জুন ওই মহিলা কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করে লকডাউন উঠে গেলে তিনি পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতায় রাজি আছেন বলে জানান। যদিও পুলিশ ৪১ এ ধারাই সমন পাঠিয়ে তলব করে তাকে। তিনি ওই এফআইআর খারিজের আবেদন জানান। যদিও ২৯ সেপ্টেম্বর কলকাতা হাইকোর্ট পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতার নির্দেশ দেন ওই মহিলাকে। তার পরেই তিনি সুপ্রিম কোর্টে যান তার বিরুদ্ধে।
রাজ্য সরকারের তরফে দাবি করা হয়, ওই মহিলাকে কোনভাবেই অসম্মান বা হেনস্থা করা হয়নি। সরকারের আইনজীবীর পাল্টা যুক্তি, ৪১এ ধারায় নোটিশে কাউকে পুলিশ তলব করলে আদালত সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তার আরও বক্তব্য, রাজ্য কেন তার বিরোধিতা করবে? তিনি হাইকোর্টে জানিয়েছিলেন পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতা করবেন। পুলিশ শুধু ওনাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায়।
এর উত্তরে সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের বক্তব্য, আমরা দেশের প্রথম প্রতিষ্ঠান যারা নাগরিক কোন ভুল করলে তা স্মরণ করিয়ে দিই। তারা সব সময় আইনের কাছে উত্তর দিতে বাধ্য। কিন্তু এমন ক্ষেত্রে নয়। আমরা এখানে সাধারন একজন নাগরিকের হেনস্থা হয়েছে বলে মনে করছি। সুপ্রিম কোর্ট আরো জানিয়ে দেয়, শুধুমাত্র সরকারের সমালোচনা করায়, এমন ঘটনায় কোনো নাগরিককে এইভাবে এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে তলব করার ক্ষেত্রে ডেকে পাঠানোয় তাদের প্রবল আপত্তি রয়েছে।
এর পরেই সুপ্রিম কোর্ট চার সপ্তাহের সময় দেয় রাজ্য সরকারকে তাদের বক্তব্য জানানোর জন্য। এরই মধ্যে কলকাতা হাইকোর্টকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ওই মহিলার এফআইআর খারিজ করার মামলাটি শুনানি করার জন্য।
মোদি- দিদিদের জমানায় সাধারণমানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় সরকারের সমালোচনা করলেই, পুলিশ যেভাবে পারলে কোমরে দড়ি দিয়ে তাদের তুলে নিয়ে গিয়ে সবক শেখানোর চেষ্টা করে, সেই প্রবণতায় সুপ্রিম কোর্টের এই রায় যথেষ্টই ইতিবাচক বলে মনে করছেন আইনজীবিদের একটা বড় অংশ।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version