জীবিকার তাগিদে দুই যুবক জেরি ও জোয়ি ঠিক করলেন তাঁরা সায়েন্স ফিকশন লিখবেন। কিন্তু তাঁদের গল্প কোনো প্রকাশকই ছাপাতে রাজি হলনা। শেষে তাঁরা নিজেরাই একটি ম্যাগাজিন নাম সায়েন্স ফিকশন বের করেন। সেই ম্যাগাজিনের তৃতীয় সংখ্যায় তাঁরা একটি গল্প ‘দ্য রেইন অফ দ্য সুপারম্যান’ প্রকাশ করেন। তবে সেই সুপারম্যান আমাদের চেনা-জানা সুপারম্যান নয়। সেই সুপারম্যান ছিল টাক মাথা, উন্মাদ এবং সে তার টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা দিয়ে পুরো দুনিয়া শাসন করতে চেয়েছিল। ফলে এই ভিলেন সুপারম্যান সাড়া ফেলতে পারলো না কারণ, তখনও পাঠক এরকম একটি চরিত্রের জন্য তৈরি ছিল না।
যদিও তাঁরা সেই চরিত্রটিকে নিয়েই ভাবনা-চিন্তা চালিয়ে গেলেন। চরিত্রটিকে পুরাণ এবং পপকালচারের সংমিশ্রণে নতুনভাবে সাজিয়ে নিলেন। জোয়ি তাকে সার্কাস অ্যাক্রোব্যাটদের মতো কস্টিউম পরালেন। সুপারম্যান পরিণত হল পৃথিবীতে আশ্রয় নেওয়া এক শরণার্থী, যে বহুদূরের এক গ্রহ থেকে এসেছে এবং সে নিজে তার সুপারম্যান পরিচয় সবসময় গোপন রাখত। তার আরেকটি পরিচয় ছিল, ক্লার্ক কেন্ট। যে একজন নম্র স্বভাবের রিপোর্টার। সে মেট্রোপলিস (ফ্রিৎস ল্যাং পরিচালিত মেট্রোপলিস সিনেমা অবলম্বনে এই শহরের নাম নেওয়া হয়) শহরের ডেইলি স্টার (যেটা পরবর্তীতে পরিবর্তন করে ডেইলি প্ল্যানেট করা হয়) পত্রিকায় কাজ করে। এইভাবে জেরি ও জোয়ি মৌলিক একটি চরিত্র সৃষ্টি করলেন। কিন্তু তাতেও কোনো প্রকাশক সুপারম্যানের প্রতি আগ্রহী হল না। তাদের মত, সুপারম্যান কাঁচা হাতের কাজ, এমন গল্প কেউ পড়বে না। এরপর জেরি এবং জোয়ি কমিকবুক রাইটার এবং আর্টিস্ট হিসেবে কাজ নিলেন ন্যাশনাল এলাইড পাবলিশিংয়ে, যারা ডিটেকটিভ কমিকসের সফলতার পর ডিসি কমিকসে পরিণত হয়। ডিসি কমিকস সিদ্ধান্ত নেয় তারা অ্যাকশন কমিকস নামে নতুন কমিকবুক সিরিজ প্রকাশ করবে। সেই সিরিজের জন্য তাদের একটি চরিত্রের প্রয়োজন ছিল। সৌভাগ্যবশত, তারা সেই চরিত্রটির জন্য সুপারম্যানকে বেছে নেয়। অ্যাকশন কমিকসের প্রথম ইস্যুতেই জেরি আর জোইয়ের অনেকদিনের স্বপ্ন পূরণ করে কমিকসের রঙিন পাতায় আবির্ভূত হল সুপারম্যান।
অ্যাকশন কমিকসের ওই ইস্যুটি বর্তমানে সবচাইতে দামী কমিকবুক। ২০১৪ সালে এর একটি কপি বিক্রি হয়েছিল ৩২,০৭,৮৫২ মার্কিন ডলারে। জানা যায়, সুপারম্যান নামকরণের পিছনে জর্জ বানার্ড শ’য়ের নাটক- ম্যান এন্ড সুপারম্যান-এর ভূমিকা ছিল। কারণ এরপরেই সুপারম্যান শব্দটি পপ কালচার হিসেবে পরিচিতি পায়। তবে এই শব্দটির প্রয়োগ প্রথম দেখা যায় জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিক নিটশের প্রবন্ধ ‘Also Sparch Zarathusra’তে। সেই প্রবন্ধে জার্মান শব্দ Übermensch-কে অনেক ইংরেজ অনুবাদক সুপারম্যান হিসেবে অনুবাদ করেন। সুপারম্যানের সঙ্গে জড়িত লইস লেন নামটি নেওয়া হয়েছিল অভিনেত্রী লোলা লেনের নাম অনুসারে। চরিত্রটি সৃষ্টি করা হয় গ্লেন্ডা ফেরেল অভিনীত টর্চি ব্লেন অনুকরণে। আর লইস লেনকে আঁকা হয় জোলান কোভ্যাকস নামক এক মডেলের অনুকরণে, পরে যিনি নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখেন জোয়ান কার্টার। কিছুদিন পর তিনি জেরি সিগ্যালের সহধর্মিণী হন। জোয়ান সিগাল বলেছিলেন তিনি জোয়ি শাস্টারকে সুপারম্যানের ছবি আঁকতে দেখেছিলেন, যেখানে মডেল হিসেবে ছিলেন জেরি সিগাল কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আবার ক্লার্ক কেন্টের পেশা হিসেবে রিপোর্টার বেছে নেয়া হয় যেটা ছোটবেলায় জেরির স্বপ্ন ছিল।
প্রায় সব সুপারহিরোরাই মুখোশ পড়ে কিন্তু সুপারম্যান পড়ে না। কারণ তার বিশ্বাস মুখোশ পড়ে সে মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারবে না। কিন্তু দুটি আলাদা পরিচয়ে চলাফেরা করতে তাকে ছদ্মবেশ নিতে হয়। চশমা পড়া সে ছদ্মবেশেরই অংশ। প্রশ্ন কেন সুপারম্যানকে চশমা পড়লে চেনা যায়না। এর কারণ চশমা তার একমাত্র ছদ্মবেশ নয়। সুপারম্যান দুটি চরিত্রকে এমনভাবে আলাদা করে রাখে যে কেউ কখনো মাথাতে আনতে পারে না। ক্লার্ক কেন্ট সবসময়ই অপ্রস্তুত, ভীতু, সে কিছুটা ঝুঁকে থাকে, নরম স্বরে কথা বলে আর এমন জামাকাপড় পড়ে যাতে তার পেশিবহুল শরীর বোঝা না যায়। সুপারম্যানের অসাধারণ ক্ষমতা। যদিও প্রথমদিকে দ্রুত গতিতে চলা, বেশ শক্তিশালী এবং লম্বা লাফ দেওয়া বাদে আর কোন ক্ষমতা ছিল না। প্রথমদিকে সুপারম্যান উড়তেও পারত না। হলুদ সূর্য থেকে শক্তিও ছিল না। তবে এত ক্ষমতার কারণ হল, ক্রিপ্টোনিয়ানরা যৌবনে উপনীত হবার পর দানবীয় কিছু শক্তি পেয়ে থাকে। হলুদ সূর্যের বিষয়টি আসে সিলভার এজে। তারপর হিট ভিশন, এক্স-রে ভিশন, ফ্রিজিং ব্রেথ, হিপনোটিজম, ভেন্ট্রিকুইলিজম, টেলিকাইনেসিস, শক্তিশালী ইন্দ্রিয়, হিলিং পাওয়ার, সুপার ওয়েভিং। এই সময়ে সুপারম্যান ছিল অপ্রতিরোধ্য, শত আঘাতেও তার কিছু হত না। তবে তার দুর্বলতা ছিল ক্রিপ্টোনাইটে। সে টাইম ব্যারিয়ারও ভাঙতে পারত, যার মাধ্যমে একবার সে অতীতে চলে গিয়েছিল। এতসব ক্ষমতার কারণে সুপারম্যান অনেকটাই ঐশ্বরিক চরিত্র। কিন্তু ব্রোঞ্জ এজে থেকে সুপারম্যানের ক্ষমতা অনেকটাই কমিয়ে আনা হয়। মডার্ন এজেও সুপারম্যানের সুপার স্পিড, হিট ভিশন, এক্স-রে ভিশন, ফ্রিজিং ব্রেথ ইত্যাদি ক্ষমতা ছিল। তবে তার ক্ষমতা কমিয়ে আনা হয় ডেথ অফ সুপারম্যান গল্পে। অন্যদিকে ম্যান অফ স্টিল কমিকসে তাকে নতুন ক্ষমতা দেওয়া হয়- সুপার ফ্লেয়ার। যার মাধ্যমে সুপারম্যান ভিতরে জমে থাকা সমস্ত শক্তি সোলার ফ্লেয়ার রূপে ছেড়ে দিতে পারে। তবে এরপর সুপারম্যান তার সব ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং একদিন সূর্যস্নানের পর আবার সবকিছু ফিরে পায়।