কড়ি মোলাস্কা বা গ্যাস্ট্রোপোডা শ্রেণির সামুদ্রিক প্রাণী সহজ ভাষায় বিশেষ এক ধরনের ক্ষুদ্র শামুক হলেও যখন টাকার উদ্ভব হয়নি, তখন কিন্তু বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে কড়ি ব্যবহৃত হত। মুদ্রা আবিস্কারের পরও আফ্রিকার নানা স্থান, আমেরিকার আদিবাসী জনপদ, ভারতে এমনকি বাংলাতেও মুদ্রার বিকল্প হিসেবে কড়ির প্রচলন ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে সম্রাট অশোকের শাসনে ব্রাহ্মী ভাষায় প্রচারিত মহাস্থান শিলালিপিতে স্থানীয় গভর্নরকে দুর্ভিক্ষের সময় জনগণকে ‘গণ্ডক’ ও ‘কাকনিক’ সাহায্য করার নির্দেশ রয়েছে। ইতিহাসবিদদের মতে, ‘গণ্ডক’ ও ‘কাকনিক’ মূলত কড়ি গণনার একক।

কড়ি ব্যবহারের প্রমাণ মেলে প্রায় চার হাজার বছর আগে। কিন্তু বাংলায় ঠিক কবে নাগাদ কড়ি চালু ছিল তা স্পষ্ট নয়। তবে খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে পাল-সেন যুগ, মধ্যযুগের মুসলিম শাসন এমনকি ব্রিটিশ আমলের প্রায় ১৯ শতক পর্যন্ত বাংলায় মুদ্রা হিসেবে কড়ির প্রচলন ছিল। চর্যাপদেও বিনিময় কাজে কড়ি ব্যবহারের কথা স্পষ্টভাবেই রয়েছে। চোদ্দ শতকে ইবনে বতুতা তাঁর সফরে বাংলায় কড়ির ব্যবহার দেখেছিলেন। সফরনামা ‘কিতাবুর রেহালা’র বর্ণনায় মেলে, মালদ্বীপের বাসিন্দারা টাকাপয়সা হিসেবে কড়ি ব্যবহার করতেন। বাংলার অধিবাসীদের কাছে চালের বিনিময়ে কড়ি বিক্রি করতেন। কারণ, বাংলায় কড়ি অর্থ হিসেবে ব্যবহৃত হত। পনেরো শতকের আরেক ভ্রমণকারী চীনা রাজদূত মা-হুয়ান লিখেছেন, বাংলায় রুপার মুদ্রা চালু ছিল তবে বড়সড় ব্যবসায়িক লেনদেন চলত ওই মুদ্রায়। কিন্তু ছোটখাটো কেনাকাটায় চলত কড়ি। অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংরেজ আমলে যেমন ভারতে কড়ির ব্যবহার ছিল, তেমনি ইংল্যান্ডেও সেই কড়ির চাহিদা ছিল ব্যাপক। ১৭১৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রস্তাব দিয়েছিল, সারা বছর যে কড়ি এ দেশে রাজস্ব হিসেবে আদায় হবে, তা এক্সপোর্ট ওয়্যার হাউসের রক্ষকের কাছে পাঠাতে হবে। উল্লেখ্য, ইংল্যান্ডে ক্রীতদাস কেনাবেচায় কড়ির প্রচলন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।

কড়ি নিয়ে এই আলোচনা প্রসঙ্গে বলতে হয়, বিনিময়ের এই কড়ি কিন্তু আমাদের দেশীয় ‘কড়ি’ নয়! অর্থাৎ আমাদের দেশে যেসব কড়ি পাওয়া যায় সেগুলি টাকা হিসেবে ব্যবহৃত হত না। আগেই বলেছি ইবনে বতুতার বিবরণ জানায়, চালের বিনিময়ে মালদ্বীপ থেকে আমাদের দেশে কড়ি আমদানি করা হত। মূলত আমাদের দেশীয় কড়ির সঙ্গে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত কড়ির রঙ, আকৃতি ছিল আলাদা। ভারত মহাসাগর থেকে সংগৃহীত এসব কড়ি ছিল দুধ-সাদা রঙের এবং খানিকটা চ্যাপ্টা আকৃতির। তবে বাংলায় বিনিময়ের মুদ্রা হিসেবে কড়ি বাংলার অর্থ-সমাজ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল। যে কারণে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও প্রবচনে কড়ি  কথাটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়েছিল। দোলায় আছে ছপন কড়ি, গুনতে গুনতে যাব, ফেলো কড়ি মাখো তেল, আমার হাতে এখন কানাকড়িও নেই।

১৮১৭ সালে মুদ্রা হিসেবে কড়িকে বিলুপ্ত করার ফলে উড়িষ্যার পাইকা বিদ্রোহ হয়েছিল। মূলত ব্রিটিশদের কড়ি মুদ্রা বিলুপ্ত করে রৌপ্যে কর দেওয়ার প্রথা প্রচলনে জোর দেওয়ার জন্যই পাইকা বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল। যতদূর জানা যায়, ১৮২১ সালে ১ টাকার সমান ছিল ২ হাজার ৫৬০টি কড়ি। তবে কড়ির এই হিসাব মূল্য সব জায়গাতে এক ছিলনা, একেক অঞ্চলে ছিল একেক রকম। ইউরোপের বিরাট এক কালো অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কড়ি। অলঙ্কার হিসেবে ব্যবহৃত কড়ি ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের প্রভাবে একটা সময় হয়ে উঠেছিল দাসব্যবসার মূল হাতিয়ার। ষোড়শ শতকে ইউরোপীয়রা যখন ভারতীয় উপকূলে দাস ব্যবসা শুরু করে তখন কড়ির চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ফরাসি এবং ইংরেজদের আফ্রিকার দালালদের কাছ থেকে ক্রীতদাস কেনার জন্য মালদ্বীপের কড়ির প্রয়োজন ছিল। লাভজনক সুযোগ খুঁজে পেয়ে বাংলার ব্যবসায়ীরা ইউরোপীয়দের কাছে বিক্রির জন্য মালদ্বীপ থেকে কড়ি সংগ্রহ শুরু করে। ক্রীতদাস ব্যবসায়ীরা একজন আফ্রিকান ক্রীতদাস কেনার জন্য প্রায় ২৫ হাজার কড়ি দিত।  শোনা যায় উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে কলকাতার চিৎপুর রোড আর চব্বিশ পরগণার বজবজে ‘দাসবাজার’ ছিল। চিৎপুরের নদীর তীর জুড়ে ক্রীতদাস ক্রয়-বিক্রয় হত। পর্তুগিজ ক্রীতদাস জাহাজগুলি ভিড়ত বজবজে। এই দুই জায়গা থেকে সড়ক অথবা নদীপথে ক্রীতদাসদের নিয়ে যাওয়া হত।

ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো এশিয়া জুড়েই অভিজাত এবং রাজপরিবারগুলিতে কাফ্রি নামে পরিচিত আফ্রিকান ক্রীতদাস, বিশেষ করে ‘হাবশি’ নামে পরিচিত ইথিওপীয় বা আবিসিনীয় ক্রীতদাসদের প্রচুর চাহিদা ছিল। ১৭৮০ এবং ১৭৯০-এর দশকে কলকাতার পত্রপত্রিকায় ক্রীতদাস বাণিজ্য-সম্পর্কিত প্রচুর ইংরেজি বিজ্ঞাপন পাওয়া যায়। এই ক্রীতদাসরা সেনাবাহিনীতে সৈনিকের পাশাপাশি রাজকীয় হারেম এবং অভিজাত নারীদের প্রহরী হিসেবে কাজ করত। কলকাতা ছাড়াও বাংলার অন্যান্য বন্দর, যেমন- চট্টগ্রাম এবং উড়িষ্যার বালাসোরও ছিল দাসব্যবসার আঞ্চলিক কেন্দ্র। বাংলার কিছু জায়গায় পুরুষ ক্রীতদাসদের দিয়ে জমিতে কৃষক হিসেবে অনেক সময় গৃহস্থালির কাজ করানো হত। অন্যদিকে, নারী ক্রীতদাসদের প্রায়ই তাদের মালিকেরা ভোগ করত। তখন ক্রীতদাসরা মালিকের সামাজিক মর্যাদারও একটি প্রতিক ছিল কার কত বেশি দাস এই হিসেবে।বাংলায় কড়ির ব্যবহার কমতে থাকে দাস ব্যবসা বিলুপ্ত হওয়ার পর থেকেই। কারণ, দাস ব্যবসাকে কেন্দ্র করেই কড়ি ব্যাপকতা লাভ করেছিল। গোটা দাস ব্যবসার বেচাকেনা হত মূলত কড়ির মাধ্যমেই। ১৮৩৪ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট তাদের সবগুলি উপনিবেশে দাসপ্রথা বিলুপ্ত করার ঘোষণা করে। এর ফলে বাংলার দাস ব্যবসা মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তাছাড়া ১৮৩০ সাল নাগাদ বাংলায় ধাতব মুদ্রা  প্রচলন শুরু হওয়ার পর থেকে কড়ির ব্যবহার বিলুপ্ত হতে থাকে।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version