দুর্বৃত্তরা নিজেদের বিষয়ে স্পষ্ট করেই যেন জানিয়ে দিতে চাইছে যে ওরা বেপরোয়া আর দুঃসাহসী। এমনটাই মনে হচ্ছে কারণ, আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ঘটনা নিয়ে যতই হইচই হোক না কেন, রাজ্যে নারী নির্যাতন ও খুনের ঘটনা থামানো যাচ্ছে না, বরং ঘটেই চলেছে। সাধারণ মানুষ প্রতিদিন প্রতি মুহুর্তে যে ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষোভবিক্ষোভে ফেটে পড়ছেন, আন্দোলনের ঝাঁজ বাড়াচ্ছেন, জনরোষ যেভাবে শহরনগর ছাড়িয়ে প্রত্যন্তে পৌঁছে যাচ্ছে তার তো একটা ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া থাকবে, কিন্তু আমরা কি দেখছি- আরজি করের ঘটনার পর রাজ্যের নানা জায়গায় ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা বা অপরাধের তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ হয়ে চলেছে। জয়নগর, পটাশপুরের পর গত ৪৮ ঘন্টার মধ্যে আরও দুটি ঘটনা যুক্ত হল। গত দু’দিনে দু’জন নারীর দেহ উদ্ধার হয়েছে কৃষ্ণনগর ও পুরুলিয়া থেকে। দু’জনকেই খুন করা হয়েছে এবং ধর্ষণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ। কৃষ্ণনগরে যে তরুণীর অর্ধনগ্ন দেহ উদ্ধার হয়েছে, তার মুখ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, পুরুলিয়ার বরাবাজার এলাকার সিন্ধ্রিতে যে তরুণীর মৃতদেহ বালিতে পুঁতে রাখা হয় তাকেও খুন করে পুঁতে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ।
সাধারণ মানুষ প্রশাসনের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করছেন, আর কত শিশুকন্যা ও নারীর ধর্ষণ এবং তারপর তাকে পিটিয়ে, গলা টিপে, অ্যাসিড কিম্বা কেরোসিনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা করলে, তবে থামবে এই নারী নিধন-যজ্ঞ? রাজ্য জুড়ে প্রতিবাদে মানুষ রাস্তায় নেমেছে, মিছিল প্রতিদিন লম্বা হচ্ছে, অনেক নেতা-মন্ত্রীরা অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তির আস্ফালন করছেন, কিন্তু নারকীয় হত্যা-প্রবাহ থামছে কই? আসলে প্রশাসনের তরফে থামানোর কোনো মৌলিক চেষ্টা নেই, কোনো উদ্যোগ নেই, কোনো মানসিকতাও নেই। যদি থাকতো, তাহলে মেয়েদের ধর্ষণ-খুনের রক্তের দাগ প্রায় প্রতিদিন এমনভাবে ছিটকে এসে আমাদের গায়ে লাগত না। প্রশাসনের সক্রিয় সদিচ্ছা থাকলে ধর্ষণ-খুনের মতো এমন নৃশংসতার অসংখ্য ঘটনা নিরবচ্ছিন্নভাবে ঘটে যেত না। কোথায় সংখ্যা কত তা নিয়ে আলোচনা হত না। এটাই সত্যি যে, মেয়েদের উপর নানা ধরনের হিংসাত্মক কার্যকলাপ ঘটছে, যার মধ্যে ধর্ষণ অন্যতম। সরকারি পরিসংখ্যানের উল্লেখ না করাই ভাল কারন, আসল সংখ্যাটি তার থেকে কতগুণ বেশি তা অনুমান করা কঠিন। ঘটনা কামদুনি হোক আর কাটোয়া, একটি বিষয় স্পষ্ট যে মেয়ের বয়স ২-৩ বছর হোক আর ৭০-৭৫ বছরের প্রবীণা কেউই আর নিরাপদ নয়। বাড়ির বাইরে গেলে মোটেও সে নিরাপদ নয় কারণ, রাজ্য প্রশাসন তাকে নিরাপত্তা নিতে সম্পূর্নভাবেই ব্যার্থ। তাই মেয়ে যে অক্ষত অবস্থায় নিশ্চিন্তে বাড়িতে ফিরবে- এই ভরসা বাড়ির লোকেরা আর পাচ্ছেন না।
ওদিকে এখনও তাঁর ভাববার বা দেখবার ফুরসত হয়নি! পুজোর অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে তাঁর উৎসব। এখনও যে তার রেশ কাটেনি তা বোঝা গেল রেড রোডের মঞ্চে তাঁর ফুরফুরে মেজাজ দেখে। উৎসব শুরু করেছিলেন একের পর এক পুজো উদ্বোধন দিয়ে। মণ্ডপে, মণ্ডপে উপস্থিত হয়ে ফিতে কাটা কিংবা অনলাইন, সব মিলিয়ে বারোশোর উপর উদ্বোধন এবং ভাষণ। এই কাজটি আর কেইবা পারেন। একটি পুজো উদ্বোধনে বেরিয়ে মাননীয়ার মন্তব্য করলেন, ‘দু’-একটা ঘটনা কখনও ঘটে যায় বাংলায়’। তাই বলে উৎসবে ব্যাঘাত কেন! কিন্তু তারপর তিনি কি দেখলেন বাংলায়! যে উৎসব ছিল আনন্দ আর খুশীর, সেই উৎসবে মিশে গেল বিষণ্ণতার সুর, প্রতিবাদের ঢেউ পড়লো আছড়ে, হয়ে উঠল দ্রোহকালের এক অনন্য উৎসব। তিনি চুটিয়ে পুজো ‘এনজয়’ করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন, কোনোদিকে তাকাতে বারণও করেছিলেন। এই পরামর্শ তো তাঁকে দিতেই হবে কারণ, তুঁষের আগুম ধিকি ধিকি জ্বলতে জ্বলতে দাবানল হয়ে ওঠে।
গোটা উৎসব পর্বে বাংলাজুড়ে মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ রাস্তায়, মিছিলে, সমাবেশে, স্লোগানে, গানে কবিতায় এমনকি খোদ উৎসবের আঙিনাও দখল করে নিল। এমন অভুতপূর্ব আন্দোলনের স্রোত বাংলার সমজ জীবনকে যে প্রবলভাবে নড়িয়ে দেবে তা ছিল তাঁর কল্পনার বাইরে। কোনোদিকে তাকাতে যে তিনি বারণ করছেন, তার কারণ কোনোদিকে তাকানোর সাহস তিনি নিজেই পাচ্ছেন না। আন্দোলনের এমন আবেগ, এমন স্পর্ধা তিনি আগে কখনও দেখেন নি। তিনি নিজেই দিশেহারা। তাঁর দলের নেতা-মন্ত্রীরা হুমকি দিয়ে কুকথা বলছেন, তিনি নিজেও ফোঁস করতে বলেছেন, কখনও অন্য ভাষায়, অন্য কথায় গোলমাল পাকাচ্ছেন। তাঁর দলদাস পুলিশটুলিশেরা তেরেমেরে এসেও দুর্বার গণজাগরণের সামনে চুপসে যাচ্ছে অথবা লেজ গুটিয়ে পালাচ্ছে। যদিও তারা আন্দোলনের বিভিন্ন সংগঠক এমনকি সাধারণ মানুষকে সুযোগ পেলেই হেনস্তা করছে। আসলে এই আন্দোলনের ভাষা একেবারেই আলাদা, মোকাবিলার পদ্ধতি প্রকরণও সিলেবাসের বাইরে। অন্যদিকে হুমকি-সংস্কৃতিই ওদের চেনা পথ, একমাত্র জানা রাস্তা। মোট কথা শাসক যে প্রতিবাদের কণ্ঠ রুদ্ধ করে, প্রতিরোধকে ফাটকে পুরতে চেয়েছিল, সেই প্রতিবাদ-প্রতিরোধ রাজপথে মিছিল-ধরনা-জমায়েতে ‘জনতার মুখরিত সখ্যে’ বারেবারে ফিরে আসছে রক্তচক্ষু, জুলুমের তোয়াক্কা না করেই। এখন তাঁর একমাত্র চিন্তা এই অজানা বিপদ ঠেকাবেন কি করে?
দু’মাসেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত। তার মধ্যেই জয়নগরে উদ্ধার হয়েছে ন’বছরের বালিকার দেহ। ধর্ষণ-খুনের অভিযোগে উত্তাল হয়েছে সেই এলাকা এবং এ রাজ্যের মানুষ। পটাশপুরে উদ্ধার হয়েছে নিখোঁজ গৃহবধূর দেহ। ধর্ষণ করে বিষ খাইয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। পার্ক স্ট্রিট থানায় মহিলা সিভিক পুলিশের ওপর শ্লীলতাহানির ঘটনায় অভিযুক্ত খোদ কলকাতা পুলিশেরই কর্মী। এর উপর কৃষ্ণনগর, পুরুলিয়া নতুন অভিঘাত তৈরি করেছে বাংলার সমাজ জীবনে। এরাজ্যের নারীদের উপর কেবলমাত্র এক মাসেই একের পর এক ঘটনা লাগামহীনভাবে ঘটেছে। এসব কিছুই নয়, তেমন কোনো বড় ঘটনা নয়, সব ছেড়ে তাই উৎসবে মত্ত থাকার ডাক, হ্যাঁ একদিকে রক্তের গঙ্গা আর তার পাশে উদ্দাম-উন্মত্ত নৃত্যগীতে গা ভাসিয়ে দেওয়ার আহ্বান কেবলমাত্র তিনিই দিতে পারেন। কার্নিভালের জেদও তাঁর একাই থাকতে পারে। কিন্তু তাঁকে দেখতে হল ক্ষোভ থেকে উৎসারিত জেদের অনবদ্য এক কার্নিভাল, যা সরকারি ভাণ্ডারের লক্ষ-কোটি টাকা ব্যায়ের কার্নিভালকে কেবল ম্লান করেই দেয়নি জাগরিত জনতার প্রতিস্পর্ধা সেই কার্নিভালকে ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে। হ্যাঁ বিলাসবহুল মঞ্চ ছিলনা, বেশ্যার বৈভবও নয়, মুখ ঢাকতে হয়নি বাহারি নিয়নে মুখ, দ্রোহকালের ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ আলোড়নে ‘দ্রোহের কার্নিভাল’ কিন্তু জয় করে নিল বাংলাকে। তিনি একা ভীষণ একা হয়েই বসে রইলেন উৎসবের ঢাল হাতে। হায়! পালিয়ে কোথায় যাবেন আপনি।