এ দেশে প্রথম পেশাদার মহিলা ফটোগ্রাফার কে? মিসেস ই. মায়ার ওল্ড কোর্ট হাউজ স্ট্রিট কর্নারে মেয়েদের জন্য স্টুডিও খুলেছিলেন। কিন্তু তাঁর স্টুডিও মেয়েদের খুব একটা আকর্ষণ করেনি। মিসেস ই. মায়ারের আগেও কয়েকজন নারী ফটোগ্রাফারের নাম পাওয়া যায় বেঙ্গল ফটোগ্রাফিক সোসাইটির প্রথম বার্ষিক অধিবেশনে- মিসেস মৌয়ট, মিসেস টি টমসন ও মিসেস সি বি ইয়ং। তবে এদের ছবি সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। মিসেস ই. মায়ার মেয়েদের স্টুডিও সফল হয়নি। তবে তিনি নিজে ফটোগ্রাফার হিসেবে সফল ছিলেন। মিসেস মায়ারের পর ফটোগ্রাফিতে কার্যকর ভূমিকা রেখেছেন মিসেস ডি গ্যারিক। তিনি ওয়াটারলু স্ট্রিটে মেয়েদের জন্য স্টুডিও খুলেছিলেন কিন্তু স্টুডিওটি এক বছরের মাথায় বন্ধ হয়ে যায়। এর পর মেয়েদের স্টুডিও খোলেন লালা দীন দয়াল। তিনি স্টুডিও খুলেছিলেন হায়দরাবাদে, তাঁর স্টুডিও নিয়ে পুরুষ ফটোগ্রাফাররা দারুণ কৌতূহল দেখিয়েছিলেন।
প্রসঙ্গত, দীন দয়ালের মেদের স্টুডিওর কয়েক বছর আগে কিন্তু বাঙালি মেয়েদের ছবি তোলার স্টুডিও খুলেছিলেন মিসেস উইন্স। তিনি কেবল ছবি তোলা নয়, মেয়েদের ফটোগ্রাফি শেখানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি ঘরে ঘরে গিয়ে মেয়েদের ফটোগ্রাফি শেখাতেন। এর পর বাঙালি মেয়েদের ফটোগ্রাফি শেখানোর দায়িত্ব নেয় ব্রাহ্মসমাজ পরিচালিত ‘নারী শিল্প শিক্ষালয়’। ১৯১৬ সালে ৮৩ মানিকতলা স্ট্রিটে বাহ্ম ছাত্রীনিবাসে একটি শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৮৮৯ থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়ার জার্নাল থেকে বেশ কয়েকজন মহিলা ফটোগ্রাফারের নাম পাওয়া যায়। সেই তালিকায় শুধুমাত্র একজন ভারতীয় নারীর নাম আছে। ১৯০৭ সালের জার্নালে ছিল কুমারী সি সোরাবজীর নাম। উল্লেখ্য, ত্রিপুরার প্রথম ভারতীয় মহিলা ফটোগ্রাফার হিসেবে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের তৃতীয় স্ত্রী মহারানী মনমোহিনী। মনমোহিনী ছবি তুলে সেগুলি ডেভেলপও করতেন। ত্রিপুরা থেকে ১৮৯০ সালে ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়ার দপ্তরে পাঠানো আলোকচিত্রগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি ছিল মহারানী মনমোহিনীর তোলা ও প্রিন্ট করা। ঊনবিংশ শতকে ঠাকুরবাড়ির একজন মহিলা ফটোগ্রাফি করতেন। তিনি জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। ইন্দিরা দেবীর একটি চিঠি থেকে তাঁর মা জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর ফটোগ্রাফির হদিস পাওয়া যায়।
ঊনবিংশ শতকে বাঙালি নারীদের মধ্যে প্রথম পেশাদার ফটোগ্রাফি শুরু করেছিলেন সরোজিনী ঘোষ। তিনি স্টুডিও খুলেছিলেন। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দের ১০ জানুয়ারি অমৃতবাজার পত্রিকায় সরোজিনী ঘোষকে নিয়ে ‘লেডি ফটোগ্রাফার’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ‘‘৩২ কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের মহিলা আর্ট স্টুডিওর সুদক্ষা হিন্দু মহিলা শিল্পীর কাজ দেখে আমরা মুগ্ধ হয়েছি। আমাদের জন্য তিনি কিছু কাজ করেছেন যার ‘ফিনিশ’ লক্ষ্য করলে ফোটোগ্রাফার রূপে তাঁর যোগ্যতা ও দক্ষতা সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে না”। সরোজিনীর পর পেশাদার ফটোগ্রাফার হিসেবে নাম আসে অন্নপূর্ণা দেবীর। তিনিই প্রথম বাঙালি মহিলা ফটোগ্রাফিকে জীবিকা অর্জনের উপায় হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। ১২ বছর বয়সে অন্নপূর্ণার বিয়ে হয়েছিল আইনজীবী উপেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে। শুরুতে শখ করেই ফটোগ্রাফি শিখেছিলেন। পেশাদার ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করেছিলেন ১৯৩০ থেকে ১৯৪০-এর দশকে। তিনি কোনো স্টুডিও খোলেননি, নিজের বাড়িতেই কাজ করতেন। তবে ছবি তুলতে বাইরে যেতেন। ছবি ডেভেলপ, প্রিন্টিং, ফিনিশিং— সব এক হাতেই করতেন। মুসলিম সমাজে অন্নপূর্ণা দেবী বেশ সম্মান পেয়েছিলেন। কবি জসীমউদ্দীন, আব্বাস উদ্দীন আহমেদ ছিলেন অন্নপূর্ণার গুণগ্রাহী। সংসারের খরচ জোগাতে অন্নপূর্ণা ফটোগ্রাফি করেছেন।
একসময় কলকাতায় পেশাদার নারী ফটোগ্রাফার হিসেবে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন ৫ নম্বর বিবি রোজীয় লেনের চঞ্চলাবালা দাসী। তার স্টুডিওটি ছিল নিষিদ্ধপল্লীর কাছে। তাই এখানে সমাজের অভিজাত বা সাধারণ ঘরের মেয়েরা ছবি তুলতে আসতেন না। চঞ্চলাবালার ক্যামেরায় ছবি তুলতেন মূলত নিষিদ্ধপল্লীর মেয়েরা। জীবিকার প্রয়োজনেই নিষিদ্ধপল্লীর মেয়েরা ছবি তুলতেন। উল্লেখ্য, সেকালে রঙ্গমঞ্চের অভিনেত্রীরাও ছবি তুলতেন। বিখ্যাত ডাক্তার ও রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্রর দুই কন্যা মীরা চৌধুরী ও ইন্দিরা দেবী ফটোগ্রাফার হিসেবে নাম করেছিলেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ ফটোগ্রাফি জানতেন এবং নিজের দুই মেয়েকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। মীরা দেবী ব্রাউনি নম্বরে টু বক্স ক্যামেরায় ছবি তুলতে শুরু করেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ নিজে ছবি ডেভেলপ ও প্রিন্ট করতেন। মীরা দেবী এ কাজে তাকে সহায়তা করতেন। দার্জিলিংয়ে স্কুলে পড়ার সময় বন্ধুদের ছবি তুলেছেন। ১৯২৩ সালে বিয়ের পর বিলেত চলে যান। স্বামী প্রভাত চৌধুরী কিনে দেন কনটেসা নেটল ক্যামেরা। তাই দিয়ে চলে ছবি তোলা। মীরা দেবী রবীন্দ্রনাথেরও ছবি তুলেছিলেন। সেই ছবির কোণে কবির স্বাক্ষরও রয়েছে। মীরা দেবীর আরেকটি বিরাট অর্জন— তার তোলা রবীন্দ্রনাথের মুভি ফিল্ম। এর একটি অংশ সত্যজিত্ রায় তার তথ্যচিত্র ‘রবীন্দ্রনাথ’-এ ব্যবহার করেছেন। আর ইন্দিরা দেবী মূলত টেবিল টপ ফটোগ্রাফি করেছেন।
এরপর যার নাম আসে তিনি হলেন অন্নপূর্ণা গোস্বামী। তিনি পেশাদার ফটোগ্রাফার না হলেও, তাঁর ফটোগ্রাফির বিষয় হিসেবে উঠে এসেছিল দেশভাগের পর কলকাতায় আসা শরণার্থীরা। রেললাইনের পাশে কুঁড়েঘরে থাকা মানুষেরা। সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের কলকাতাও রয়েছে তাঁর ফটোগ্রাফিতে। তবে ফটোগ্রাফিই একমাত্র পরিচয় নয় তাঁর। ‘রেললাইনের ধারে’ ও ‘একফালি বারান্দা’ তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস। আরেকজন অন্নপূর্ণা গোস্বামী, তার কাজ বেশ তাত্পর্যপূর্ণ। তার ক্যামেরায় সমাজের দারিদ্র্যপীড়িত ও নিচুতলার মানুষের জীবনচিত্র ফুটে উঠেছে। রেললাইনের পাশে, বাস্তুহারা মানুষেরা ছিলেন তার আলোকচিত্রের বিষয়বস্তু। উদ্বাস্তু শিশু, পরিবার, দুর্ভিক্ষের সময় স্তূপ হয়ে থাকা চালের বস্তার ছবি তুলেছেন তিনি। এক কথায় বাঙালি নারী ফটোগ্রাফারদের কাজে তিনি নতুন যুগের সূচনা করেন।
১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪০ সালে ফটোগ্রাফার হিসেবে খ্যাতি পান দেবলীনা সেন রায় ও মনবীণা সেন রায়। ইলাস্ট্রেটেড ডেইলিতে নিয়মিত তাঁদের তোলা ছবি ছাপা হত। ১৯৫১ সালে প্রকাশিত হয় ‘টোয়েন্টি ফাইভ পোট্রেটস অব রবীন্দ্রনাথ টেগোর’। এর মধ্যে পুরীতে থাকাকালীন কবির ছবিও ছিল। তাঁদের প্রথম ফটোগ্রাফ বেরোয় ‘সচিত্র ভারত’ জার্নালে। সচিত্র ভারত পত্রিকার ১৯৩৭ ও ১৯৩৮ সালের সংখ্যাগুলোয় আরো কয়েকজন নারী ফটোগ্রাফারের নাম পাওয়া যায়— ইলা মিত্র, কাননবালা চট্টোপাধ্যায়, বীথি রায়, বেবী চৌধুরী প্রমুখ।