স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের দেশে অন্তত সাড়ে চার হাজার বাঁধ তৈরি হয়েছে ফসলের জমিতে জল দিতে আর জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে। কিন্তু তাও কি দেশের সমস্ত চাষের জমি সেচের জল পায়? না, এখনও দেশের ৬৫ শতাংশ জমিতে নদী সেচের জল পৌছায় না। চিন, রাশিয়া বা আমেরিকার তুলনায় আমাদের দেশের ছোট ও মাঝারি বাঁধ কিংবা বাঁধ দিয়ে আটকে রাখা অথবা সংরক্ষণ করা জলের পরিমাণ খুবই কম। দেশের বড় বা মূল নদীগুলিতে আর কোনো বাঁধ দেওয়ার জায়গা প্রায় নেই, তাছাড়া বাঁধ দেওয়ার কারণে অধিকাংশ নদীর জলধারণ ক্ষমতাও কমেছে ভীষণভাবে একইসঙ্গে দূষণ বেড়েছে বহু গুণ। এর ফলে চাষাবাদে ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহার বেড়েছে বিপুলভাবে। হিসাব অনুযায়ী ভূগর্ভস্থ জলের নব্বই ভাগ ব্যবহৃত হয় কৃষিতে, এই জলের পরিমাণ চিন, রাশিয়া ও আমেরিকার থেকেও অনেক বেশি। এর কারণ ভারতে ধান, গম, আখ, তুলোর মতো ফসলের চাষ হয় বেশি, এইসব ফসলের চাষ এবং বেশি ফলনের জন্য বিপুল পরিমাণ জল দরকার হয়। হিসেব অনুযায়ী এক কিলো তুলো তৈরি করতে ২০০০০ থেকে ২৫০০০ লিটার, আখে লাগে ৩০০০ লিটার, ধানে ২৫০০ থেকে ৫০০০ হাজার এবং গমে ৯০০-১০০০ লিটার দরকার হয়।

আমাদের দেশে অধিকাংশ তুলো ও আখচাষ হয় মহারাষ্ট্র ও গুজরাটে, এই রাজ্যদুটি দেশের শুষ্ক অঞ্চলের মধ্যে পড়ে। বহুদিন ধরেই ভারতের জলের আকালের জন্য দেশের ভ্রান্ত কৃষিনীতিকে দায়ী করে আসছেন পরিবেশবিদেরা। সবুজ বিপ্লব পরবর্তী সরকারি নীতির উপর চোখ রাখাস যায়, তাহলে দেখবো ভযঙ্কর এই শুষ্ক অঞ্চলের প্রধানতম ফসল, যা শুষ্ক ও খরা প্রবল অঞ্চলে মানুষকে এতো বছর বাঁচিয়ে রেখেছিল সেই জোয়ার, বাজরা, রাগির চাষ বন্ধ করে হেক্টরের পর হেক্টর আখ ও তুলা চাষ হয়েছে, তৈরি হয়েছে চিনি কল ও সুতো কল। তার ফলে জলের হাহাকার, বহু অঞ্চলে চাষ বন্ধ হওয়া ও চাষির আত্মহত্যা একটা নিয়মিত ঘটন্সা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই ভাবে পাঞ্জাব, হরিয়ানা হয়ে উঠেছে ধান কেনার কেন্দ্র। ধান, যা বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, উত্তরপূর্ব ভারত, থাইল্যান্ড, চিন ও জাপানের জলসমৃদ্ধ অঞ্চলের ফসল, তা গত ৫০ বছরে ওই সব অঞ্চলে ধান খরিফে, গম রবিতে প্রধান উৎপাদিত ফসল হয়ে গিয়েছে। আর এসবই ১০০ শতাংশ উচ্চ ফলনশীল ধান, খরিফ মরশুমে চাষ হয়, যা প্রায় বিনামূল্যে পাওয়া বিদ্যুৎ, জল আর সরকারের ন্যুনতম সাহায্যে এই সব রাজ্য থেকে ১০০ শতাংশ ধান কেনার সঙ্গে লাফিয়ে বেড়েছে, তার সঙ্গে বেড়েছে জলের অপচয়। কিন্তু পাঞ্জাবের কৃষক যার গড় জমির পরিমাণ মাথা পিছু ৩ হেক্টররেরও বেশি, তারা দেশের সবচেয়ে অর্থবান চাষি হলেও ভুল কৃষিনীতির কারণে জল ও মাটির উৎপাদনে সঙ্কটের মুখোমুখি। “ওয়াটার প্রোডাক্টিভিটি অব ক্রপ” একটি নতুন পরিমাপ যা ফসল প্রতি কতটা জল সেচ দেওয়া হল আর কত ফসল উৎপাদন হল তার হিসাব করে। আর সেই হিসেব দেখাচ্ছে যে, পাঞ্জাব ও হরিয়ানা যেমন জমিপিছু ধানের উৎপাদন সবার উপরে, তেমনি মিটার কিউব জল ব্যবহার হিসাবে এই রাজ্যগুলির উৎপাদন সবচেয়ে কম। খরাক্রান্ত মহারাষ্ট্র, যেখানেও ধান চাষ হয়, সেখানে এইটা সবচাইতে কম ও ভয়াবহ। একই চিত্র আখের ক্ষেত্রে মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু ও কর্নাটকে, অর্থাৎ ফসলের নির্বাচনটাই ভুল। আপাতত জল মিললেও সর্বনাশের বেশি বাকি নেই।

পরিস্থিতি কেবল অপেক্ষাকৃত কম জলের রাজ্যগুলিতে নয়, জলসমৃদ্ধ গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের বহু জেলায় ভূগর্ভস্থ জলের আধার প্রায় ১০০ ফুটের নীচে চলে গিয়েছে। পাঞ্জাবে ৫০০ ফুট নীচে। আসামে নিয়মিত বন্যা ও বন্যার জল সরে গেলেই জলকষ্ট এক নিয়মিত বিষয়, বিশেষ করে দক্ষিণ ব্রহ্মপুত্রের জেলাগুলিতে। চাষের কাজে অতিরিক্ত জলের আহরণ আসামের এই সমস্ত অঞ্চলে ছড়িয়েছে ফ্লোরাইড দূষণ। গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের ধান চাষে বেড়েছে আর্সেনিকের প্রাদুর্ভাব। উল্লেখ্য, এই দুটি রাজ্যে ধানের উৎপাদন কেবল হেক্টর প্রতি কম নয়, প্রতি মিটার কিউব জল পিছু উৎপাদনও কম। তবে এই রাজ্যের ধানের উৎপাদন খরিফ মরশুমে মূলত বৃষ্টি নির্ভর হলেও বোরো চাষের নলকূপের জল ধনে না হলেও মানে পাঞ্জাবের সমতুল করেছে। প্রসঙ্গত, মোট ধান উৎপাদনে সবার উপরে আছে পশ্চিমবঙ্গ। জমির পরিমাণ পাঞ্জাবের দ্বিগুণ। তবে বাংলার মোট উৎপাদিত চালের ১ শতাংশও কেন্দ্রীয় এমএসপি-র সাহায্য পায় না। তাই অধিকাংশই ভাগচাষিরা আরও গরিব হয়েছে। জোর দিয়ে বলা যায় যে গুজরাটের খরা অঞ্চলে তুলা, মহারাষ্ট্রের আখ ও পাঞ্জাবের ধানের মডেল একটি ভুল কৃষিনীতির ফসল যা আমাদের দেশের জলসম্পদের সর্বনাশ ঘটিয়েছে। দেশ সমৃদ্ধ চাষিদের ভর্তুকিতে জল ও বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ভূগর্ভস্থ জলকে মরুভূমিতে পরিণত করেছি। প্রশ্ন, পাঞ্জাবের খরিফের ধান চাষ করতে জে লক্ষ লক্ষ নলকূপ তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়েছে তাতে কি পাঞ্জাবের কৃষকদের ভাল হয়েছে? বরং প্রতি ঘন মিটার জলে কত কেজি উতপাদন হচ্ছে ও চাষিরা জমিতে জল ও মাটির উর্বরতা রক্ষার জন্য ঠিক কী কী পদক্ষেপ করছে সেই কাজ যে ঠিক মতো হয়নি সেটা দেরিতে হলেও স্পষ্ট হয়েছে। সরকারের ন্যুনতম সহায়তা বা কৃষি সংক্রান্ত সব সুযোগসুবিধা কেবল একটি দুটি রাজ্যে নয়, গোটা দেশ ও অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রেও হওয়া দরকার।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version