বিগত ৫০ বছরে দেশেএকের পর এক ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে, মৃত্যু হয়েছে কয়েক হাজার মানুষের। বিংশ এবং একুশ শতকের গোড়ার দিকে একাধিক ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার সাক্ষী থেকেছে ভারত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার পিছনে ছিল ট্রেন এবং সিগন্যালিং ব্যবস্থার যান্ত্রিক ক্রটি। এছাড়াও বেলাইন হয়ে বা আগুন লেগে বহু যাত্রীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।প্রত্যেকটি দুর্ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে দায় কার, কোথায় ত্রুটি, তা নিয়ে তদন্ত হয়েছে কিন্তু …। ট্রেন নং ১৩১৭8 শিয়ালদহ কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা আরও একবার উস্কে দিল ২০২৩ সালের ওড়িশার বালাসোরের কাছে ঘটা ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার স্মৃতিকে।
শুধুমাত্র বালাসোর নয়, ১৯৫৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মাদ্রাজ থেকে দিল্লিগামী এক্সপ্রেস ট্রেন ব্রিজ ভেঙে লাইনচ্যুত হলে ১৩৭ জন প্রাণ হারান।১৯৬৫ সালের ২৩ নভেম্বর প্রচণ্ড বৃষ্টিতে মারুদিয়ার নদীতে প্লাবনের জেরে রেল ব্রিজ ভেঙে ট্রেন নদীতে পড়ে কমপক্ষে ১৫৪ জনের মৃত্যু হয় ৷ ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনায় 800 জনেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারান ১৯৮১ সালের ৬ জুন, এই দিনে বিহারে একটি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে নদীতে পড়ে গিয়েছিল৷দক্ষিণ ভারতের কুইলনের কাছে বর্ষার কারণে ফুলে-ফেঁপে ওঠা হ্রদে একটি এক্সপ্রেস ট্রেন ডুবে যায় ১৯৮৮ সালের 8 জুলাই, কমপক্ষে ১০৬ জন নিহত হন৷ ওই বছরই ঘটে পেরুমান রেল দুর্ঘটনা।কেরালার অষ্টমুদি হ্রদের উপর পেরুমান সেতুতে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে ১০টি বগি জলে পড়ে যায়৷১৯৯৫-র ২০ আগস্ট দিল্লি থেকে ২০০ কিমি দুরে দু’টি ট্রেনের সংঘর্ষে অন্তত ৩৫০ জন মারা যান৷ ১৯৯৯-র ২ আগস্ট গাইসাল ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ২৮৫ জনের।
এরপর ২০০২, ১০ সেপ্টেম্বর বিহারের রফিগঞ্জে, ২০০৫ সালের ২৯সেপ্টেম্বর অন্ধ্রপ্রদেশের ভেলুগোন্ডার কাছে, ২০১১ সালের ১০জুলাই ফতেপুরে হাওড়া-কালকা মেল ট্রেন লাইনচ্যুত হয়, ২০১২ সালের ২২মে অন্ধ্রপ্রদেশের কাছে একটি কার্গো ট্রেন ও হুবলি-ব্যাঙ্গালোর হাম্পি এক্সপ্রেসের সংঘর্ষ হয়, ২০১৪ সালের ২৬ মে উত্তরপ্রদেশের সন্ত কবির নগর এলাকায়, গোরখপুর গামী গোরখধাম এক্সপ্রেস, খলিলাবাদ স্টেশনের কাছে একটি দাঁড়িয়ে থাকা মালগাড়ির পিছনে ধাক্কা মারে৷ ২০১৬ সালের ২০নভেম্বর উত্তরপ্রদেশের কানপুরে ইন্দোর-পাটনা এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হয়৷ ২০১৭-র ২১জানুয়ারি অন্ধ্রপ্রদেশে জগদ্দল থেকে ভুবনেশ্বরগামী হীরাখন্ড এক্সপ্রেসের বেশ কয়েকটি বগি লাইনচ্যুত হয়।মুজফ্ফরনগরে পুরী-হরিদ্বার উৎকল এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হয় ২০১৭ সালের ১৯ আগস্ট, ২০১৭ সালের ২৩ আগস্ট উত্তরপ্রদেশের আউরিয়ার কাছে দিল্লিগামী কইফিয়ত এক্সপ্রেসের নটি বগি লাইনচ্যুত হয়, ২০১৮ সালে পঞ্জাবের অমৃতসরে দশেরার দিন রাবণ দহনের সময় রেললাইনের উপরে কয়েকশো মানুষ উঠে পড়লে একটি প্যাসেঞ্জার ট্রেন প্রায় ৯০ কিমি গতিবেগে পাস করছিল, হঠাৎই ট্রেন চলে আসায় ৫৯ জন কাটা পড়ে, ২০২৩ সালের ২জুন ওড়িশার বালাসোরে করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা-যেখানে তিনটি ট্রেনের মধ্যে সংঘর্ষের জেরে কমপক্ষে ৩০০ জনের মৃত্যু হয়, ওই বছর ২৩ সেপ্টেম্বর তিরুচিরাপল্লী-শ্রী গঙ্গানগর হামসফর এসএফ এক্সপ্রেস ভালসাড় রেলওয়ে স্টেশন অতিক্রম করার সময় ইওজি ও বি-ওয়ান কোচে আগুন লেগে যায়, ২০২৩-এ লখনউ-রামেশ্বরম ভারত গৌরব ট্রেনে আগুন লাগে৷ এরপর জলপাইগুড়ি জেলার রাঙ্গাপানিতে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে ধাক্কা মারে মালগাড়ি।
এইসব ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন ওঠে ভারত সরকার নতুন নতুন ট্রেন কিনতে যতটা খরচ করে রেললাইনের সংস্কারে অতটা মনোযোগী নয়।আবার এমনও নয় যে ভারত সরকার রেলের উন্নয়নে বিনিয়োগ করছে না। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের সরকার ৩ হাজার কোটি ডলার খরচ করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক দুর্ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে নিরাপত্তাব্যবস্থায় আরও বিনিয়োগ করতে হবে। গত কয়েক বছরে ভারতে রেলব্যবস্থায় অনেক বিনিয়োগ হয়েছে, কিন্তু রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তাব্যবস্থায় বিশেষ বিনিয়োগ করা হচ্ছে না বলে খবর। নরেন্দ্র মোদীর যতটা লক্ষ্য রেলের গতি, আরাম-আয়েশ বাড়ানো বা বুলেট ট্রেন ও বেশি ভাড়ার ট্রেন নামানোতে ততটা নয় সুরক্ষায়।ভারতের রেল সেবাকে বিশ্বমানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে ঠিকই তাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করাও হয়ত সম্ভব হবে রেলের নিরাপত্তা বাড়ছে না। বাস্তবতা হচ্ছে, ভারতের ১৩ হাজার পুরোনো ট্রেনের নিরাপত্তাব্যবস্থার উন্নতিতে বিনিয়োগের পরিমাণ কমেছে। সবশেষ বাজেটেও দেখা গেছে, রেলের নিরাপত্তায় বরাদ্দ মোট বাজেটের অনুপাত ও টাকার অঙ্ক— দুদিক থেকেই কমেছে।