[ ১৯৬৬ র জুনে কবি নজরুল ইসলাম শেষ বারের মতো তার জন্মভূমি চুরুলিয়ায় আসেন । ফেরার পথে কবি কল্লোল যুগের সাহিত্যিক কালীপদ ঘটকের বাড়ী রৈবতকে বিশ্রাম নিয়ে বিকালে ট্রেন ধরে কলকাতয় ফেরেন। সেই গোটা দিনের সাক্ষী ছিলেন শিশির চট্টরাজ। কোভিডে সদ্য প্রয়াত শিল্পী শিশির চট্টরাজের সঙ্গে মাসখানেক কবি সন্দর্শনের সেই দূর্লভ অভিজ্ঞতা ও অনুভুতির স্মৃতিচারণার ভিত্তিতেই কবি নজরুল ইসলামের ১২২ তম জন্ম জয়ন্তী উপলক্ষে গৌর শর্মার প্রতিবেদন। ]

১৫ জুন , ১৯৬৬ । আসানসোলের রেলপাড়ের ডিপুপাড়ায় সাহিত্যিক কালীপদ ঘটকের বাড়ী রৈবতক – এ পদার্পন করবেন কবি নজরুল ইসলাম । তাই সকাল থেকেই ঘটক বাড়ীতে চরম ব্যস্ততা । বাড়ীর হেঁসেল সামলাতে ব্যস্ত গৃহকর্ত্রী শঙ্করী ঘটক । বাকি সমস্ত বিষয়ে তদারকি করছেন গূহকর্তা সাহিত্যিক কালীপদ ঘটক স্বয়ং। রান্নাঘরে তৈর হচ্ছে ভাত, ডাল ও মাছের ঝোলের সাথে কবির প্রিয় পোস্তের বড়া। দিন কয়েক আগেই চুরুলিয়ায় এসছেন কবি। কলকাতায় ফেরার পথে কালীপদ ঘটকের বাড়ী হয়ে আসানসোল থেকে ট্রেন ধরবেন কবি। সেকালে শিল্পাঞ্চলের সাহিত্য জগতে কালীপদ ঘটকের বাড়ী রৈবতকের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য । রৈবতকে প্রতিনিয়ত বসতো সাহিত্য ও কবিতার আসর , বাউল গানের আখরা এবং যা্ত্রা –থিয়েটার নিয়ে আলোচনা । এই আসরে আড্ডা জমাতেন কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর , অচিন্ত্য সেনগুপ্ত , শৈলজানন্দ, ফাল্গুনীসহ অসংখ্য কবি সাহিত্যিক জ্ঞানীজন । রৈবতকে কবি নজরুলের পদার্পন ছিল এক যুগান্তকারী নব সংযোজন । এদিন সকাল নটা নাগাদ রৈবতকে এসে পৌঁছলেন নজরুল । সঙ্গে কবি পুত্র সব্যসাচী তার পরিবারের সদস্যরা । রৈবতকে কবির বিশ্রাম যাতে কোন ভবে বিঘ্নিত না হয় সেই জন্য কবির আগমন বার্তা সেদিন গোপন রাখা হয়ে ছিল। কিন্তু কবির আগমন বার্তা চাউর হতে সেদিন বেশী সময় লাগেনি জনমানসে । গ্রীস্মের প্রখরতাকে উপেক্ষা করে নজরুল প্রেমীরা কবি দর্শেন উপস্থিত হয়ে ছিলেন ডিপুপাড়ায় সাহিত্যিক কালীপদ ঘটকের বাড়ী রৈবতকে। ভিড় সামলাতে সেদিন খুলে দিতে হয়ে ছিল বাড়ীর বাগানের পেছনের দরজা ।


নজরুল প্রেমীদের কবি দর্শনের মাঝেই দেখা দিল কবির আস্থিরতা । সব্যসাচী চিৎকার করে উঠলেন – কালীপদ দা শীগগীর গান । গায়ক বিনয় দাসকে আনতে লোক পাঠালেন কালীপদ ঘটক । কিন্তু গান যে এই মুহূর্তেই চাই । অগত্যা রবীন্দ্র সঙ্গীত ধরলেন বিনয় দাসের এক সুকন্ঠী ছাত্রী ও কালীপদ বাবুর মেয়ে শ্যামলী । গান ধরলেন সুকন্ঠী সুখিয়া করিম । অস্থির কবি তখন ধীরে শান্ত হচ্ছেন , চোখের কোনায় তার বিন্দু বিন্দু জল । ইতি মধ্যেই এসে পৌঁছান নজরুল গীতি গায়ক বিনয় দাস । উদাত্ত কন্ঠে তিনি ধরলেন নজরুলের শ্যামা সঙ্গীত- “ জগত জুড়ে জাল ফেলেছিস মা
শ্যামা কি তুই জেলের মেযে ‘”


গান শেষ হতেই শান্ত কবি নিজের গলার বেলফুলের মালাটি খুলে ছুঁড়ে দিলেন গায়ক বিনয় দাসকে । আবেগ অপ্লূত বিনয় দাস করজোড়ে তুলে নিজের মাথায় ঠেকালেন কবির দেওয়া আর্শীবাদ মাল্যখানি। পরম বিস্ময়ে অভিভুত উপস্থিত নজরুল প্রেমীরা। ক্ষনিকের জন্য এক বিন্দু নিঃস্তব্ধতা , রূপ নিল এক দীর্ঘতম নিঃস্তব্ধতায়। মধ্যাহ্ন ভোজনের পর এগিয়ে এল বিদায় বেলা। ব্ল্যাক ডায়মন্ড ধরতে কালীপদ ঘটকের মোটর গাড়ীতে কবিকে নিয়ে যাওয়া হবে আসানসোল স্টেশনে। রেলপাড় মনিমেলার সদস্যরা কবিকে গার্ড অফ অনার দিয়ে আসানসোল স্টেশনে পৌঁছে দিলেন । বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম শেষ বারের মতো ছুঁয়ে গেলেন চুরুলিয়াসহ আসানসোলের মাটি । কবির পদার্পনের স্মৃতিতে বিজরিত হলো আসানসোলের রৈবতক ।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version