কলকাতা ব্যুরো: বিগত কয়েকদিনে সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক মাধ্যমে চোখ রাখলেই হট ট্রেন্ডিং দুটো টপিক। যা নিয়ে শোরগোল নেটপাড়ায়। রাজ্য তথা দেশের নিরিখে বিচার করলে একটি ছাত্র নেতা আনিস খান মৃত্যুরহস্য এবং দ্বিতীয়টি অবশ্যই রাশিয়া-ইউক্রেন (#RussiaUkraineWar) যুদ্ধ। বৃহস্পতিবার থেকে হটকেকের মতো সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট, টুইট, রিটুইট হচ্ছে পূর্ব ইউরোপের দুই রাষ্ট্রের সংঘাত। যার আঁচ এসে পড়েছে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরের পশ্চিমবঙ্গেও। উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাটের ডেপুটি সিএমওএইচ, কলকাতার রাজারহাটের বাসিন্দা চিকিৎসক শ্যামল বিশ্বাস। সরকারি চাকুরে হয়েও তাঁর সবচেয়ে প্রিয়জন নিজের মেয়ের জন্য কিছুই করতে পারছেন না তিনি। সকাল থেকে রাত অবধি সরকারের বিভিন্ন দফতরে হন্যে হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন। যদি মেয়েটাকে সুস্থভাবে বাড়ি ফেরান যায়। তবে শুধু সরকারের সাহায্যই নয়। শ্যামলবাবু হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকে পোস্ট করে রাজ্য তথা দেশবাসীর পরামর্শও জানতে চেয়েছেন। দিয়েছেন নিজের ফোন নম্বরও। ভালো কোনও খবরের আশায় বুক বাধছেন বসিরহাটের চিকিৎসক।  

মেয়ে ২১ বছরের তিয়াশা বিশ্বাস ইউক্রেনের শহর লভিভ ন্যাশনাল গভমেন্ট মেডিক্যাল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। যুদ্ধের কারনে গোটা পরিবার ইউক্রেনে থাকা মেয়েকে নিয়ে বর্তমানে ঘোর উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছেন। শ্যামলবাবুর কথায় মেয়ের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে। বললো, খুব আতঙ্কে রয়েছে। খাবারদাবারে টান পড়েছে, হস্টেলে পর্যাপ্ত খাবার মজুত নেই। রয়েছে পানীয় জলের সমস্যাও। খুবই চিন্তায় আছি। এছাড়া ওখানকার এটিএমে টাকাও নেই, ফলে টাকা তোলা সম্ভব হচ্ছে না।

আপাতত বিশ্বাসবাড়ির একটাই প্রার্থনা, মেয়ে সুস্থভাবে বাড়ি ফিরে আসুক। শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী তিয়াশা বাবাকে জানিয়েছে, ইউনিভার্সিটি অথরিটি আটকে পড়া সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের পোল্যান্ডে পাঠানোর চেষ্টা করছে। যাতে সেখান থেকে বিনা বাধায় সবাই নিজেদের দেশে ফিরতে পারেন।

একই অবস্থা উত্তর চব্বিশ পরগণার হাবড়ার জুলফিকার বিশ্বাসের। কুমড়া গ্রামপঞ্চায়েতের কাশীপুর দক্ষিণপাড়ার বাসিন্দা জুলফিকারের মেয়ে নিশা বিশ্বাস গত ডিসেম্বরের ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে ডাক্তারি পড়তে গিয়েছেন। যুদ্ধের কারনে গোটা পরিবার মেয়েকে নিয়ে ঘোর উদ্বেগে।

উত্তর ২৪ পরগনার গোবরডাঙার বেড়গুম ১ নম্বর গ্রামপঞ্চায়েতের লক্ষ্মীপুর গ্রামের বাসিন্দা দেবাশিস সাধুখাঁরও একই অবস্থা। মেয়ে স্বাগতাও তিন বছর আগে কিয়েভে গিয়েছেন ডাক্তারি পড়তে। সেখানকার মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির ছাত্রী তিনি। ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে বাড়ির লোক উদ্বেগে ছিলেন। বৃহস্পতিবার সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ লাগার খবরে ওঁদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। উড়ানও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মেয়েকে নিরাপদে বাড়ি ফিরিয়ে আনার আর্জি নিয়ে দেবাশিসবাবু জেলাশাসকের দপ্তরে যোগাযোগ করেছেন।

একই জেলায় একই রকম উদ্বেগের প্রহর গুনছে আরও এক পরিবার। বসিরহাট পুরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা অর্পণ মণ্ডল তিনবছর আগে ডাক্তারি পড়তে ইউক্রেনে গিয়েছেন। তিনি ডিনিপ্র পেট্রোভ্যাদক্স মেডিক্যাল ইনস্টিটিউটে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। শনিবার তাঁর দেশে ফেরার কথা ছিল কিন্তু উড়ান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কবে ফিরতে পারবেন দেশে ঠিক নেই। অর্পণ বৃহস্পতিবার বাড়িতে ফোন করে নিজের কুশল সংবাদ দিলেও মা-বাবার যে মন কিছুতেই মানছে না। বসিরহাট হাইস্কুলের বাংলার শিক্ষক রামপদ মণ্ডল ও চন্দনা মণ্ডলের একমাত্র সন্তান অর্পণ বলেন, ভোর সাড়ে চারটেয় বিস্ফোরণের শব্দে ঘুম ভাঙে। হস্টেল থেকে বেরিয়ে জানতে পারলাম, রাশিয়া অ্যাটাক করেছে। সুপার মার্কেট ভিড়ে ভিড়াক্কার, সবাই খাবার স্টক করতে ব্যস্ত। এটিএম বন্ধ। যে ইউক্রেনকে ইউরোপের রুটির ঝুড়ি বলা হয় সেখানেই রুটি পাওয়া যাচ্ছে না। রামপদবাবুর কথায়, ভীষণ চিন্তায় রয়েছি। আমার মতো অনেক মা-বাবার তরফে ভারত সরকারের কাছে আর্জি, সন্তানদের দ্রুত বাড়ি ফেরানোর ব্যবস্থা হোক।

ছেলেকে ফেরাতে সরকারের কাছে কাতর আবেদন জানাচ্ছেন উপকূলবর্তী পূর্ব মেদিনীপুরের এক পরিবারও। নন্দকুমার থানার ভূঞ্জাখালি গ্রামের অর্ণব মান্না ডাক্তারি পড়তে গিয়ে ইউক্রেনে আটকে পড়েছেন। রুশ হামলার খবর পেয়ে বাড়ির লোকের উদ্বেগের অন্ত নেই।

পাশাপাশি ইউক্রেন সংঘাতের জেরে উত্তরবঙ্গেও বইছে চিন্তার চোরাস্রোত। রাশিয়া যুদ্ধপ্রস্তুতি শুরু করতেই চার্টার্ড ফ্লাইটে ৫০ জন ভারতীয় পড়ুয়া দিল্লি ফিরে এসেছিলেন, যাঁদের মধ্যে শিলিগুড়ির তিন জন–বিতান বসু, অনন্যা মৈত্র ও সুকৃতি দেব। সবাই ডাক্তারি পড়ুয়া। যদিও বিমান না মেলায় বিতান ছাড়া এখনও কেউ শিলিগুড়িতে পা দিতে পারেননি।

বৃহস্পতিবার বিকেলে বিতান বাড়ি এসেছেন। মা বন্যা বসু বলেন, বেশ কিছু দিন ধরে ফেরার চেষ্টা করছিল, কিন্তু প্লেনের টিকিট পাচ্ছিল না। শেষে ওদের কলেজ থেকে চার্টার্ড প্লেনের ব্যবস্থা করে দেয়। বিতান জানায়, আতঙ্কে ছিলাম, তবে ঘাবড়ে যাইনি। জানতাম, যে করে হোক দেশে ফিরতেই হবে। সপ্তাহখানেক আগে ভারতীয় দূতাবাসই আমাদের ফিরে আসার পরামর্শ দিয়েছিল। আমার অনেক বন্ধু ওখানে আটকে রয়েছে। আশা করি, ওরা নিরাপদে থাকবে। জানা গিয়েছে, অনন্যা ও সুকৃতি আজ শুক্রবার শিলিগুড়ি ফিরবেন।

কিন্তু এই স্বস্তির মধ্যেও রয়েছে বিষাদের ছায়া কারণ, ইউক্রেনে আটকে রয়েছে শিলিগুড়ির আর এক ছাত্র প্রীতম মালাকার। চিকিৎসক পীযূষকান্তি মালাকারের ছেলে প্রীতমও ডাক্তারি পড়তে সে দেশে গিয়েছেন। পীযূষবাবু বলেন, খুব চিন্তায় আছি। শেষবার যখন কথা হলো, জানালো পরিস্থিতি খুব খারাপ।

বৃহস্পতিবার ভোরে ইউক্রেনের মাটিতে রাশিয়ার আক্রমণ আছড়ে পড়তেই দুশ্চিন্তা গ্রাস করেছে একাধিক পরিবারকে। যাদের কেউ না কেউ ইউক্রেনে রয়েছেন, প্রায় সবাই মেডিক্যাল শিক্ষার্থী। এদিকে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে উড়ানও বন্ধ। এমতাবস্থায় বিদেশ-বিভুঁইয়ে আটকে পড়া ছেলেমেয়ের কুশল-চিন্তায় বাড়ির লোকেদের ঘুম ছুটেছে। এখন তাঁদের নিরাপদে সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য কিছু অভিভাবক কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসনের দ্বারস্থ। তবে ঘরের ছেলেমেয়ে সুস্থভাবে ঘরে ফিরুক। পরিজন থেকে পড়শি সবার এই একটাই প্রার্থনা।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version