‘লিলিথ’ নামটির মধ্যে যতই সারল্য, মাধুর্য কিংবা স্নিগ্ধ ষোড়শীর মুখ ফুটে উঠুক না কেন, এই নামটি যে চরিত্রটির সঙ্গে জড়িয়ে সে আসলে সম্পূর্ণ বিপরীত বৈশিষ্ট্যের। লিলিথকে ইহুদী মিথলজির বিখ্যাত বলা ভাল ‘কুখ্যাত’ চরিত্র। চরিত্রটির দেখা মেলে ৩য় থেকে ৫ম শতাব্দীর মাঝামাঝিতে, ব্যবিলনীয় তালমুদ বা পুরাণে। শব্দটির প্রচলিত অর্থ রাত্রি হলেও পুরাণের লিলিথ চরিত্রকে দেখানো হয় অন্ধকারের পিশাচ রূপে, যার বিচরণ ছিল রাতের অন্ধকারে। তার কাজ ছিল নবজাতক শিশু চুরি করা। ব্যবিলনীয় গ্রন্থে এমনও বলা আছে যে, কোনো পুরুষ যদি একা রাতে ঘুমায়, তাহলে সে লিলিথের ফাঁদে পড়তে পারে! বলা হত, পুরুষের সঙ্গে মিলিত হয়ে লিলিথ আরও শয়তানের জন্ম দেয়, কেননা লিলিথকে কল্পনা করা হয় অনিয়ন্ত্রিত যৌনতার প্রতীক হিসেবে। বোঝাই যাচ্ছে লিলিথকে কতটা ভয়ানক চরিত্র হিসেবে কল্পনা করা হত। এমনকি নবজাত শিশুদের গলায় তাবিজ বেধে দেওয়া হত যাতে তারা লিলিথের কবল থেকে মুক্ত থাকতে পারে।
তবে লিলিথকে কোথাও দেখানো হয়েছে অ্যাডামের প্রথম স্ত্রী রূপে! এই তত্ত্বসূত্র ইহুদী ধর্মগ্রন্থ ‘জেনেসিস’, যেখানে বর্ণিত হয়েছে মানবজাতি ও পৃথিবীর সৃষ্টি উপাখ্যান। বুক অফ জেনেসিসে পুরুষ ও নারীর একই সময়ে সৃষ্টির কথা বলা হয়। “So God created man in his own image, in the image of God created he him; male and female created he them.” অর্থাৎ নর ও নারীর একইসঙ্গে সৃষ্টির বিষয়টি ইহুদী ধর্মে স্বীকৃত। তাহলে কি কোনো কারণে অ্যাডাম সেই প্রথম সঙ্গিনীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর আছে জেনেসিস রাব্বাহতে-তে। জেনেসিস রাব্বাহতে বর্ণিত একটি মিদ্রাশে পাওয়া যায় এডাম-লিলিথের সম্পর্কের টানাপোড়েন ও পরিণতির উপাখ্যান। পরবর্তীতে ৯ম-১০ম শতাব্দীর দিকে ‘এলফাবেট অফ বেন সিরা’-তে লেখা হয় লিলিথের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হবার করুণ উপাখ্যান। … অ্যাডামকে সৃষ্টির পর ঈশ্বর তার একাকীত্ব দূর করার কথা ভাবলেন। সঙ্গিনী হিসেবে সৃষ্টি করলেন লিলিথকে। লিলিথ বুদ্ধিদীপ্ত, আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন এক নারী, সৃষ্টির প্রথম নারী। তার জন্ম সেই মাটি থেকে, যেখান থেকে অ্যাডামের জন্ম। যার কারণে পরবর্তীতে অ্যাডামের আধিপত্য লিলিথ মেনে নিতে চায় নি। নিজেকে সে অ্যাডামের সমকক্ষ দাবী করেছে আর সেখান থেকেই অ্যাডামের মনে লিলিথের প্রতি বিরুদ্ধ চিন্তা।
মিদ্রাশ অনুযায়ী, সৃষ্টির পরপরই লিলিথের সঙ্গে অ্যাডামের দ্বন্দ্ব শুরু হয় মূলত সঙ্গমের সময়। নিজেকে শ্রেষ্ঠ দাবী করা অ্যাডাম লিলিথকে বোঝাতে চায় তার জায়গা উপরে নয়, নীচে। লিলিথ তা মানতে অস্বীকার করে। যে শ্রেষ্ঠতার দাবী অ্যাডাম করে আসছে, তা সে এক নিমেষে উড়িয়ে দেয়। সে যুক্তি দেয়, যেহেতু একই মাটি থেকে একই ভাবে তাদের সৃষ্টি, সেহেতু অ্যাডাম নিজেকে শ্রেষ্ঠ দাবী করতে পারে না, পারে না তার উপর কর্তৃত্ব করতে। এতসব মতভেদ দেখে স্বর্গে থাকার ইচ্ছা চলে যায় লিলিথের। স্বেচ্ছায় স্বর্গ থেকে মর্ত্যে নামে লিলিথ! লিলিথের ব্যবহারে রুষ্ট অ্যাডাম স্রষ্টার কাছে গিয়ে লিলিথের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে, এমন সঙ্গিনী তাকে কেন দেওয়া হলো যে তার কথা শোনে না? যে তাকে ছেড়ে পালিয়ে গেল? লিলিথের উপর বিরক্ত হয়ে স্রষ্টা লিলিথকে খুঁজে বের করতে লোক পাঠায়। তারা লিলিথের জন্য স্রষ্টার বার্তাও নিয়ে যায়- যদি সে ফিরে আসে, মেনে নেয় অ্যাডামের কর্তৃত্ব, তাহলে তাকে ক্ষমা করা হবে আর যদি সে প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে তাকে শাস্তি পেতে হবে। স্রষ্টার লোকেরা লিলিথকে মিশরের এক সমুদ্র তীরে খুঁজে পায় এবং তাদের সঙ্গে ফিরে যেতে বলে তাকে। কিন্তু লিলিথ জানায় সে আর ফিরে যাবে না। এরপর তাকে ফিরে না যাওয়ার শাস্তি শোনানো হয়। শুনে লিলিথ বলে, আমি জানি ঈশ্বর আমাকে তৈরি করেছেন কেবলই নবজাতকের প্রতি দূর্বল করার জন্য। তাও আমার অধিকার বজায় থাকবে কেবল আটদিন যদি শিশুপুত্র হয় আর কন্যাশিশুর ক্ষেত্রে তা বারোদিন। লিলিথ জানতো ঈশ্বর অ্যাডামের পক্ষ নেবে, তাছাড়া লিলিথকে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন অ্যাডামকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য।
ইহুদী মিথলজিতে লিলিথকে যেভাবেই প্রকাশ করা হোক না কেন, সাহিত্যিকদের চোখে লিলিথ বরাবরই এক আকর্ষণীয়া নারী চরিত্র হিসাবে প্রতীয়মান হয়েছে। পরবর্তীতে বিভিন্ন শিল্পীর কল্পনা থেকে আঁকা লিলিথ দেখলেই তা বোঝা যায়। এমনকি লিলিথের উপাখ্যান নিয়ে রচিত হয়েছে সনেট! ব্রিটিশ কবি ও চিত্রশিল্পী দান্তে গ্যাব্রিয়েল রোসেতি নিজের কল্পনা থেকে লিলিথকে এঁকেছিলেন এবং ‘লিলিথ’ নামে সনেটে তাঁর কল্পনার লিলিথকে অ্যাডামের প্রথম স্ত্রী হিসাবেই বর্ণনা করেছেন। ইহুদী মিথলজিতে লিলিথকে একদিক থেকে যেমন দেখানো হয়েছে অন্ধকারের প্রতিরূপ হিসাবে, অন্যদিকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তার এক বিদ্রোহী রূপ। স্বর্গের সুখ ছেড়ে আসা এক নারী, কিংবা নিজের অধিকারের জন্যে একা লড়ে যাওয়া এক দৃঢ়চেতা চরিত্র।