কলকাতা ব্যুরো: দুই নারীকে নিয়ে চর্চা এখন অসম থেকে দিল্লি পর্যন্ত। কাজের পরিধি আলাদা হলেও দুজনের ইউএসপি একটাই, তা হলো অদম্য সাহস আর হার না মানা মনোভাব। একজন অসমের ভূমিকন্যা, আরেকজন তামিলনাড়ুর হয়েও অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে গিয়েছেন অসমের সঙ্গে। একজন “লৌহ কন্যা” আর অপরজন “শেরনি” হিসাবেই বেশি পরিচিতি পেয়েছেন। প্রথমজন আইপিএস অফিসার সংযুক্তা পরাশর আর দ্বিতীয়জন আইএফএস অফিসার কে এম অভর্ণা। সংযুক্তা জঙ্গি দমনে পরিচিতি পেয়েছেন, আর অভর্ণা জঙ্গলের বাঘকে সামলে এখন শেরনী। দুজনেরই বাস্তব জীবনের গল্প ছাপিয়ে গেছে সবকিছুকেই। আর সেই কারনেই অসম তথা সারা দেশ জুড়ে চর্চার একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু এই দুই নারী।

এই তো বেশিদিনও হয় নি। মাস তিনেক আগে অসমের এক মহিলা আইপিএস কর্তার নাম জেনেছিল গোটা দেশ। তিনিই সংযুক্তা পরাশর। দিল্লি পুলিশের বিরুদ্ধে লিঙ্গবৈষম্যের অভিযোগ এনেছিলেন সংযুক্তা। সাদা পোশাকে কর্তব্যরত সংযুক্তার গাড়ি থামিয়ে তাঁকে জেরা করেছিল দিল্লি পুলিশ। এমনকি পরিচয় দেওয়ার পরও বিশ্বাস করতে চায়নি তিনি একজন আইপিএস কর্তা। চাকরি সূত্রে পাওয়া নিজের সরকারি গাড়ি নিজেই চালাচ্ছিলেন সংযুক্তা। দিল্লি পুলিশের ওই আচরণে অসন্তুষ্ট হয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘লিঙ্গবৈষম্য নিয়ে দিল্লি পুলিশের মানসিকতার বদল হওয়া দরকার। কারণ ওঁদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, আমার বয়সি একজন মহিলা যিনি আইপিএস অফিসারের গাড়ি নিজেই চালাচ্ছেন, তিনি নিজেও একজন আইপিএস হতে পারেন।’

আর এরপরই দিল্লি পুলিশের তথাকথিত আভিজাত্য এবং ‘দিল কি পুলিশ’ ট্যাগলাইন নিয়েও কটাক্ষ করেছিলেন অসমের ওই আইপিএস। টুইটারে বলেছিলেন, ‘অভিজাত দিল্লি পুলিশের এই মানসিকতা এবং সংস্কৃতির প্রভাব আকছার সমাজেও দেখা যায়।’ আর এই ঘটনার পরই দেশের বিদ্বজ্জনেরা তো বটেই, সাধারণ মানুষও সংযুক্তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর প্রতি দিল্লি পুলিশের আচরণের নিন্দা করেছিলেন সকলেই। দিল্লি পুলিশও এই অভিযোগের কোনও সদুত্তর দিতে পারেনি।

তবে সংযুক্তা বরাবরই সাহসী। সত্য কথনে আর সঠিক কাজে তিনি কোনও দিন পিছিয়ে আসেননি। শুরু থেকেই নিজের কাজে বদ্ধপরিকর। ২০০৮ সালে তাঁর প্রথম পোস্টিং হয় মাকুমে। বোড়ো জঙ্গিদের সঙ্গে তখন রীতিমতো সংঘর্ষ চলছে বাংলাদেশি শরণার্থীদের। অ্যাসিস্ট্যান্ট কমাড্যান্ট পদে নিযুক্ত হওয়া সংযুক্তাকেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পাঠানো হয় উদলগিরিতে। জানা যায় সেসময় হাতে একে ৪৭ নিয়ে জঙ্গলে দাপিয়ে বেড়াতেন তিনি। দেড় বছরে তাঁর শিকার হন ১৬ জন জঙ্গি।

পরে সিআরপিএফ দলের নেত্রী হিসেবে প্রচুর অস্ত্রও উদ্ধার করেছিলেন তিনি। গ্রেপ্তার করেছিলেন প্রায় ৬৪ জন জঙ্গিকে। তাঁরই নেতৃত্বে অসমে সেনা কনভয়ের উপর হামলাকারী জঙ্গিদেরও গ্রেফতার করে অসম পুলিশ। তবে আইপিএস কর্তা হিসাবে প্রথমেই এমন কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে ঘাবড়ে যাননি সংযুক্তা। লড়াই করে গিয়েছেন চোখে চোখ রেখে। আর এরপরই তাঁর ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালাতে শুরু করে জঙ্গিরা। সংযুক্তার জন্যই অসমের বোড়ো উপদ্রুত এলাকাগুলিতে দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। এমনকি ইভ টিজারদের দৌরাত্ম্য কমাতে তাঁর পদক্ষেপও প্রশংসিত হয়েছিল। তবে অসমের মানুষের কাছে সংযুক্তা একদম ঘরের মেয়ে। ভালোবেসে তাঁকে ডাকা হয় ‘লৌহ কন্যা’ বলে।

তিন বছর অসমের জোরহাটের পুলিশ সুপার ছিলেন। পরে সোনিপতেও একই দায়িত্ব সামলেছেন। আপাতত দিল্লিতে কর্মরত তিনি। বর্তমানে চার বছরের জন্য এনআইএ-এর পুলিশ সুপার হিসাবে নিযুক্ত হয়েছেন তিনি। তবে একদিকে যেমন তিনি কঠিন, তেমনই আবার অন্যদিকে অত্যন্ত নরম। রাস্তায় হেলমেট পড়ে বেরোলে বাইক আরোহীদের লজেন্স দেওয়ার নিয়মও চালু করেছিলেন এই সংযুক্তাই। আবার একইভাবে ইভটিজিং কমাতে কলেজের সামনে সাদা পোশাকের পুলিশও মোতায়ন করার পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনিই। যা পরবর্তীতে যথেষ্ট কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়।

এবার আসা যাক আইএফএস অফিসার কে এম অভর্ণার গল্পে। তামিলনাড়ুর ইরোডের গোবিচেট্টিপালায়ামের মেয়ে অভর্ণার পরিবারে তিনিই প্রথম আইএফএস। চেহারা দেখলে মনে হতেই পারে ভারতনাট্যম শিল্পী বা শিক্ষিকা। তেমন কিছুও হতেই পারতেন। কিন্তু ছোট থেকেই জঙ্গল আর প্রকৃতির প্রেমে পড়ে যান। সেই টানেই পুরুষশাসিত সাম্রাজ্যে পা রাখা। অবশ্য ব্যক্তিগত জীবনে বাবা-মা, আইএফএস স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ির পূর্ণ সহযোগিতা ও সমর্থন পেয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে জানান, টি-১ পর্ব তাঁকে আরও অনেক নতুন পরিবার দিয়েছে। তবে কর্মজীবনের প্রথম দিন থেকেই তিনি অদম্য সাহসের পরিচয় দিয়েছেন অভর্ণা। অসমের কাজিরাঙার সেন্ট্রাল রেঞ্জ ইনচার্জ হন বা হোক বা মহারাষ্ট্রের পান্ধারকাওয়াড়ার রেঞ্জের ডেপুটি কনজারভেটর যে দায়িত্ব তিনি নিয়েছেন দাঁতে দাঁত চেপে পালন করেছেন, সফল হয়েছেন।

আর এই বাস্তবের দাপুটে অভর্ণার জীবনের গল্প এখন সিনেমার পর্দায়। সম্প্রতি নিউটন ছবির পরিচালক অমিত মাসুকর অ্যামাজন অরিজিনালে তুলে ধরেন “শেরনি”। রিল লাইফে বিদ্যা বালানের দুরন্ত অভিনয় শৈলী যেন পরোক্ষে মনে করাতে বাধ্য করে অভর্ণাকে। দুটো প্রেক্ষাপট একেবারে ভিন্ন। তবুও অভর্ণা আর বিদ্যা যেন একে অপরের পরিপূরক। একই উদ্যম, একই রকম জেদ, একই রকম সাহস, একই রকম মানসিক জোর। “শেরনি” ছবিতে দেখা গেছে বাঘের অত্যাচারে যখন গ্রামবাসীরা নাজেহাল, এক এক করে প্রাণ যাচ্ছে গ্রামের মানুষের। ঠিক সেই সময়েই এলাকার ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের অফিসার হয়ে আসেন বিদ্যা। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কাজের জায়গাতেও প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয় তাকে। গল্পটা কিছুটা হলেও এক। তবে বাস্তব আর রিল লাইফে তা মোকাবিলা করার শক্তি বা সাহস একেবারেই আলাদা।

তবে বাস্তব আর সিনেমা দুটো যে বড্ড আকাশ পাতাল পার্থক্য। এখানেও তাই। অবশ্য অভর্ণা মেনে নেন, সিনেমা কখনওই তথ্যচিত্র হতে পারে না। আর মূল ধারার বলিউড এই প্রথম এমন বিশদ ও বাস্তবনিষ্ঠ ভাবে সংরক্ষণ ও জঙ্গলের সমস্যা তুলে ধরায় পরিচালক অমিত মাসুরকরকে কুর্নিশ জানান অভর্ণা। প্রসঙ্গত, অভর্ণা যখন কাজিরাঙা দাপাচ্ছেন, তখনই মহারাষ্ট্রের ইয়াভাতমালের জঙ্গল-গ্রামে আতঙ্ক ছড়ানো শুরু করেছে অবনী ওরফে টি-১। অসম থেকে মহারাষ্ট্রে বদলি হওয়ার পরে সেই বাঘিনিকে ধরার ভার পড়ে অভর্ণার ওপরে। তখন তিনি ডেপুটি কনজারভেটর অব ফরেস্ট। বন দফতর, আমলাতন্ত্র, রাজনৈতিক অসহযোগিতা, প্রতিকূলতার মধ্যেও বরাবরের নেত্রী অভর্ণা ২০১৭-র অগস্ট থেকে ২০১৮ সালের নভেম্বর পর্যন্ত টি-১ বাঘিনিকে রক্ষা করেছেন। গোলাঘাটে বেশ কিছু ক্ষেত্রে গ্রামে ঢোকা চিতাবাঘকে সফল ভাবে জঙ্গলে ফেরানোয় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অভর্ণা।

২০১৮ সালের নভেম্বরে বন দফতরের নিযুক্ত শিকারি নবাব শতাফ আলি খানের ছেলে আসগর আলি খানের গুলিতে অবনী মারা যায়। টি-১ হত্যা নিয়ে মামলা, তদন্ত আড়াই বছর ধরে চলছে। অভর্ণা বলেন, যে ভাবে নবাব ও তার ছেলে শেষ পর্যন্ত অবনীকে মেরেছে, বন দফতর কখনওই তা চায়নি। গ্রামবাসীদের একাংশও বাঘটিকে মেরে ফেলতে চাইছিলেন। কিন্তু বাঘ বাঁচাতেও গ্রামেরই অনেকে আমাদের সাহায্য করেছেন।

বাঘের সঙ্গে লড়াই করা থেকে গণ্ডারের তাড়া খেয়ে প্রানে বাঁচা, একাধিকবার নিশ্চিত মৃত্যুকে জয় করে বেঁচে ফিরেছেন তিনি। তবে তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন এমন সবাই বলেন, অভর্ণা সবসময় কাঁধে রাইফেল নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। রাতদিন এক করে জঙ্গলে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। তবে বন্যপ্রাণীদের উপর তাঁর ছিল অগাধ প্রেম। মহারাষ্ট্রের জঙ্গলে রাতের অন্ধকারে বাঘের মোকাবিলা যদি বন্য জীবনের চ্যালেঞ্জ নেওয়া শিখিয়ে থাকে, অসমে ফুঁসতে থাকা মারমুখী জনতার ব্যূহ ভেদ করে অপরাধীদের আদালতে পৌঁছে দেওয়ার কয়েকটা ঘণ্টা তাঁকে শিখিয়েছে জনরোষ সামলানোর ধৈর্য। আর কাজিরাঙায় গন্ডারের মুখোমুখি হওয়ার মুহূর্তটা অভর্ণার ভিতর থেকে মৃত্যুভয় মুছে দিয়ে ভরসা জুগিয়েছে। তাই তিনি অকুতোভয়। মৃত্যুকে তিনি ভয় পান না। তবে অভর্ণা বারবার জানান, পরবর্তী জীবনে রাজনীতি-আমলাতন্ত্রের সঙ্গে লড়তে হলেও অসমে কাটানো সময় তাঁর কাছে সেরা।

দূরবিনে দৃষ্টি আর রাইফেলের ট্রিগারে আঙুল চেপে কেটেছিল তাঁর কাজিরাঙার দিন-রাত। তিনি যে ক’মাস কোহরায় ছিলেন, শিকারের একটিও ঘটনা ঘটেনি। শুধু গন্ডার শিকারই নয়, কোহরা রেঞ্জে গ্রামবাসীদের অবৈধ ভাবে মাছ শিকার বন্ধ করতেও সফল হয়েছিলেন অভর্ণা। লেডি এসিএফ-এর উদ্যোগে জঙ্গল ও তার আশপাশে নিষিদ্ধ হয়েছিল প্লাস্টিকের ব্যবহার। কাজিরাঙায় মহিলা অফিসার হিসেবে শুধু নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করাই নয়, মহিলা বনকর্মীদেরও উৎসাহ দিয়ে তিনি রাইফেল হাতে বনটহলে নিযুক্ত করেছিলেন।

তবে সেইসব সোনালি দিন এখন অতীত। বর্তমানে মহারাষ্ট্রের ‘ব্যাম্বু রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার’-এর অধিকর্তা পদে নিযুক্ত অভর্ণা। মন জঙ্গলে পড়ে থাকলেও আমলাতন্ত্রের কাছে পোষ না মানা শেরনি বর্তমানে বাঁশের বেড়ায় আটকে পড়েছেন। সরাসরি না বললেও তিনি বলেন “জঙ্গলের পোস্টিং খুব মিস করি! কী আর করব, সবই জীবনের অঙ্গ।”

তবে লৌহ কন্যা ও শেরনির এই পথ কোনদিনও সহজ সরল ছিলো না। আজও নেই। প্রতি মুহূর্তেই আছে জীবনের ঝুঁকি। কিন্তু সবকিছুকে ডোন্ট কেয়ার করে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছেন সংযুক্তা। তবে ঠিক কি কারনে তাঁকে অসম ছেড়ে দিল্লি ও মহারাষ্ট্রে পাকাপাকিভাবে চলে যেতে হলো দুজনকে? তা নিয়ে জল্পনার শেষ নেই। তবে এর পিছনে আমলাতন্ত্র যে বড় চ্যালেঞ্জ তা অস্বীকার করা অসম্ভব। কিন্তু একটা বিষয় বলতেই হয়, সংযুক্তা ও অভর্ণার মতো অফিসারদের দেশের প্রয়োজন। তবে দুই মহীয়সীই দুই বিন্দু দিয়ে সিন্ধু জয় করেছেন, আর সেখানেই কোথাও না কোথাও তাঁরা এক ও অদ্বিতীয়া হয়ে উঠেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক বেড়াজালে শুধু একটি নির্দিষ্ট জায়গায় আবদ্ধ না রেখে দেশের ও দেশবাসীর স্বার্থে তাঁদের বিভিন্ন রাজ্যে স্পেশাল দায়িত্ব দিয়ে কাজে লাগানো হোক। আরও অনেক বিশেষ সাফল্যের অধিকারিণী হন তাঁরা। এতে আপকা ভালা, সবকা ভালাই। 

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version