দ্বাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের সাফোকের উলপিট নামের একটি গ্রামে আশ্চর্য একটি ঘটনা ঘটে। ঘটনাটিকে আশ্চর্যের বললেও কম বলা হয়। তবে সেই ঘটনা শুধুমাত্র অবাক ইংল্যান্ড নয়, অবাক করে দেয় গোটা বিশ্বকে।
ইংল্যান্ড তখন শাসন করছিলেন রাজা স্টিফেন। শরতের এক সকালে ইংল্যান্ডের সাফোক কাউন্টির উলপিট গ্রামের লোকজন তখন মাঠে নেমেছে ধান কাটতে। গ্রামের অদূরে জঙ্গল। সেখানে নেকড়ের ভয় তাই ওই জঙ্গলে গ্রামবাসীরা কেউ যেত না। কিন্তু আচমকা সেই জঙ্গল থেকেই বেরিয়ে এল দুটি বাচ্চা ছেলেমেয়ে। তাদের দুজনকে দেখে এক গ্রামবাসী আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলেন। চাষের কাজ ফেলে সবাই দৌড়ে এল। এসে দেখল, দুটি ছেলে-মেয়ে কিন্তু তারা আর পাঁচটা সাধারণ ছেলে মেয়ের মতো নয়। শিশু দুটির গায়ের রঙ সবুজ, পড়নে উদ্ভট পোশাক। তাদের পরিচয় জানতে চাইলে শিশু দুটি উদ্ভট ভাষায় কথা বলতে শুরু করে। শিশু দুটিকে সেখানকার স্থানীয় এক জমিদারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় কিন্তু সেখানে শিশু দুটি থাকতে চায়না।
তারা কেবল মটরশুটি এবং কাঁচা শিম খেয়ে থাকত। তবে,পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ-খাওয়াতে না পেরে শিশু দুটি মানসিক বিষন্নতা থেকে বিভিন্ন অসুখে ভুগতে শুরু করে। ছেলেটি তো এক সময় মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। অন্যদিকে মেয়েটি নতুন জীবনের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়। তাকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা হয়। মেয়েটিকে একটি পরিবার দত্তকও নেয়। তাকে ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে শেখানোর পর তাকে যখন তার অতীত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়, তখন খুব সামান্য কথাই জানা যায় মেয়েটির কাছ থেকে।মেয়েটি সম্পর্কে ‘‘Rather loose and wanton in her conduct’’ নামক একটি বইয়েও উল্লেখ করা হয়। সেখান থেকে জানা যায়, শিশু দুটি সম্পর্কে ভাই বোন ছিল। দুজন এসেছিল সেন্টমার্টিন থেকে। সেখানকার এমন একটি গ্রামের কথা বলা হয় যেখানে সর্বদা চোখ ধাঁধানো আলো থাকে। আর এর পাশে একটি নদী বয়ে চলেছে এবং সেখানকার সব অধিবাসীদের গায়ের রঙই সবুজ। তারা দুই ভাইবোন দিক হারিয়ে এসে পড়েছিল উলপিটের গ্রামে। কোন গ্রামে সবুজ রঙের অধিবাসীরা বাস করে তা খুঁজে বের করতে অনুসন্ধানও চালিয়েছিল গ্রামবাসী। কিন্তু সেখানে নদী ছাড়া কিছু মেলেনি।
মেয়েটি বড় হওয়ার পর নর্টফোক রাজ্যের কিংস লিনের এক যুবককে বিয়ে করেন। পরবর্তীতে মেয়েটির নামকরণ হয় আগনেস বাড়ৈ। এই মানব শিশু দুটিকে নিয়ে অনেকে ভিন্ন মতামতও দিয়েছেন। অনেকের ধারণা শিশু দুটি অ্যানিমিয়া বা রক্তসল্পতায় ভুগছিল। সেই সময়টাতে এই অসুখটিকে বলা হত গ্রীন সিকনেস।তাই হয়তো তাদের গায়ের রঙ সবুজ ছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, শিশু দুটি ফ্লেমিশ পরিবারের শিশু যারা যুদ্ধের সময় সেন্টমার্টিনে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। র্দীঘদিন না খেয়ে থাকায় বাচ্চা দুটির শরীরে ক্লোরোসিস তৈরি হয় বলে তাদের গায়ের রঙ সবুজ বর্ণ ধারণ করে। চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি নিয়ে শত শত বছর ধরে চলেছিল রীতিমতো গবেষণা এবং এখনও তা চলছে। গবেষকদের কেউ বলেছেন, শিশুদুটি ছিল নরফোক কাউন্টির অত্যাচারী জমিদারের আত্মীয়। অনাথ শিশুদুটিকে মেরে তাদের সম্পত্তি হাতিয়ে নেবার জন্য খাবারে আর্সেনিক মিশিয়ে দিয়েছিলেন জমিদার আর্ল। বিষের প্রভাবে শিশুদুটির গায়ের রঙ হয়ে গিয়েছিল সবুজ।
কোনও গবেষক বলেছেন, শিশুদুটি এসেছিল উলপিটের পাশের গ্রাম সেন্ট মার্টিন থেকে। গ্রামে যুদ্ধ লাগলে প্রাণ বাঁচাতে তারা আশ্রয় নিয়েছিল পরিত্যক্ত খনির ভেতর। খনিগর্ভে লুকিয়ে থাকার সময় শ্যাওলা লেগে বদলে গিয়েছিল গায়ের রঙ। কিংবা তারা হয়ত ভুগছিল রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়ায়। যাকে তখন বলা হত ‘গ্রিন সিকনেস’। এই রোগের সাথে তখনও অপরিচিত ছিলেন উলপিট গ্রামবাসীরা। তাই সবুজ রঙের শিশু দুটিকে দেখে আতঙ্কে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। পরে পুষ্টিকর খাবার পেয়ে ফিরে এসেছিল বালকাটির ত্বকের স্বাভাবিক বর্ণ।
ইতিহাসবিদ পল হ্যারিস বলেছিলেন, একাদশ-দ্বাদশ শতকে, উত্তর বেলজিয়ামের ফ্ল্যান্ডার্স থেকে দলে দলে জার্মান বংশদ্ভুত ফ্লেমিশরা এসেছিল ব্রিটেনে শরণার্থী হয়ে। ওই শতকেই, ১১৭৩ সালে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় হেনরি ও প্রধান বিচারপতি রবার্ট ডি বিউমন্টের মধ্যে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। সেই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিলেন অসংখ্য ফ্লেমিশ। যুদ্ধক্ষেত্রটি ছিল সেন্ট এডমন্টবারির উত্তরে। যেখান থেকে মাত্র ১১ কিমি দূরে ছিল উলপিট গ্রাম। প্রাণে বাঁচতে একটি ফ্লেমিশ পরিবার পালিয়ে এসে উলপিট গ্রামের কাছে থাকা একটি নেকড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল। বাবা-মা মারা গেলেও সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিল শিশু দুটি। একদিন গুহা থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজে পেয়েছিল তারা। দীর্ঘদিন ধরে অনাহারে থাকতে থাকতে শিশুদুটির শরীরে হাইপোক্রোমিক অ্যানিমিয়া বা গ্রিন সিকনেস হয়েছিল বলে শিশুদুটির গায়ের রঙ হালকা সবুজ হয়ে গিয়েছিল।