শ্যাম বেনেগাল ছিলেন ভারতীয় সিনেমার নতুন তরঙ্গের অগ্রদূত। ১৯৩৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর হায়দরাবাদের এক কোঙ্কনি পরিবারে শ্যাম বেনেগালের জন্ম। তাঁর বাবা ছিলেন পেশায় চিত্রগ্রাহক। মাত্র বারো বছর বয়সে বাবার দেওয়া ক্যামেরার মাধ্যমে প্রথম ছবি তৈরি করেছিলেন তিনি। সেখান থেকেই সিনেমা তৈরির অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন তিনি। তার আগে হায়দরাবাদের ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর সম্পূর্ণ করেছিলেন তিনি। হায়দরাবাদ ফিল্ম সোসাইটি থেকেই ছবি নির্মাণের সফর শুরু হয় কিংবদন্তী এই পরিচালকের।

১৯৭০ থেকে ১৯৮০ দশকে ভারতীয় চলচ্চিত্রকে অন্যমাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন স্বনামধন্য এই পরিচালক। বিষয় বৈচিত্র্য ও ভাবনার দিক থেকে তিনি বরাবরই ছিলেন স্বতন্ত্র। ‘মন্থন’, ‘অঙ্কুর’, ‘ভূমিকা’, ‘জুনুন’, ‘মান্ডি’, ‘নিশান্ত’ ভারতীয় সিনেমার মাইলফলক। স্মিতা পাতিল, শাবানা আজমি, নাসিরুদ্দিন শাহ, ওম পুরি তাঁর ছবিতে অভিনয়ের এক স্বতন্ত্র ধারার জন্ম দিয়েছিলেন।

উল্লেখ্য, গত ১৪ ডিসেম্বর প্রয়াত এই চলচ্চিত্র নির্মাতা তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে জন্মদিন পালন করেন। অভিনেতা কুলভূষণ খারবান্দা, নাসিরুদ্দিন শাহ, দিব্যা দত্ত, শাবানা আজমি, রাজিত কাপুর এবং অতুল তিওয়ারি সহ অন্যান্যরা সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন। অধিকন্তু, তাঁর ৯০তম জন্মদিনে, শ্যাম বেনেগাল পিটিআই-কে বলেছিলেন যে, তিনি দুই থেকে তিনটি প্রকল্পে কাজ করছেন। ‘আমরা সবাই বৃদ্ধ হই। আমি (আমার জন্মদিনে) ভালো কিছু করি না। এটি একটি বিশেষ দিন হতে পারে। তবে আমি এটি বিশেষভাবে উদযাপন করি না। আমি আমার টিমের সঙ্গে অফিসে কেক কাটলাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি দুই থেকে তিনটি প্রকল্পে কাজ করছি। সেগুলি সব বড় পর্দার জন্য। তার প্রত্যেকটি একে অপরের থেকে আলাদা। কোনটা আগে শেষ হবে সেটা বলা মুশকিল।’

শ্যাম বেনেগালের উল্লেখযোগ্য ছবি

অঙ্কুরঃ ১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় বেনেগালের প্রথম হিন্দি ছবি ‘অঙ্কুর’। এই ছবিতে গ্রামীণ ভারতের বর্ণ ও লিঙ্গ বৈষম্যকে সুন্দর ভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে। এক দলিত মহিলার সঙ্গে বাড়িওয়ালার অবৈধ সম্পর্ক দেখানো হয়েছে। ছবিতে প্রধান ভূমিকায় ছিলেন শাবানা আজমি। হিন্দি ভাষায় সেরা ফিচার ফিল্মের জন্য এই ছবিটি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল। অভিনয়ের জন্য জাতীয় পুরস্কার পান শাবানা আজমিও।

নিশান্ত ১৯৭৫-এর ছবি। গ্রামীণ ভারতের সামন্ততান্ত্রিক অত্যাচার, ফ্যাসিবাদ এবং যৌন শোষণের ছবি চিত্রায়িত হয়েছে এই সিনেমায়। গিরিশ কারনাড, শাবানা আজমি, অমরিশ পুরী, নাসিরুদ্দিন শাহ, অনন্ত নাগ, স্মিতা পাটিলের মতো কলাকুশলীরা অভিনয় করেছেন ছবিতে। সেরা ফিচার ফিল্মের জন্য জাতীয় পুরস্কার জিতেছে ‘নিশান্ত’।

১৯৭৬ সালে নির্মাণ করেন মন্থন। ভারতের হোয়াইট রেভলিউশনের প্রেক্ষাপটে তৈরি এই ছবিটি।অভিনয় করেছেন – স্মিতা পাটিল, গিরিশ কারনাড, নাসিরুদ্দিন শাহ, অমরিশ পুরী। ক্ষমতায়নের একটি কালজয়ী গল্প ‘মন্থন’ সেরা ফিচার ফিল্মের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার জিতেছে। এই সিনেমার গান ‘মেরো গাম কাঠা পেরে’ গ্রামীণ উন্নয়নের সংগীত হয়ে ওঠে।

ভূমিকা মুক্তি পায় ১৯৭৭ সালে। মারাঠি অভিনেত্রী হাঁসা ওয়াদকরের জীবন কাহিনী নিয়ে নির্মিত এই সিনেমাটি। যার মূল চরিত্রে রয়েছেন স্মিতা পাটিল। ছবিটির জন্য জাতীয় পুরস্কার জিতেছেন স্মিতা পাটিল। এছাড়া ফিল্ম ফেয়ারে সেরা সিনেমা হিসাবে পুরস্কার জিতেছে ‘ভূমিকা’।

ভূমিকার পর জুনুন নির্মাণ করেন ১৯৭৮ সালে। এক ভারতীয় যুবক এবং ব্রিটিশ নারীর প্রেমের গল্প চিত্রায়িত হয়েছে ‘জুনুন’ সিনেমায়। শশী কাপুর প্রযোজিত সিনেমাটিতে অভিনয় করেছেন – শাবানা আজমি, নাফিসা আলি, জেনিফার কেন্ডল, নাসিরুদ্দিন শাহ। ছবিটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জিতেছে।

১৯৮৩ সালে শ্যাম তৈরি করেন মান্ডি। এই ছবিতে তুলে ধরা হয়েছে হায়দ্রাবাদের এক যৌনপল্লির ঘটনা। ছবিতে অভিনয় করেছেন – শাবানা আজমি, স্মিতা পাটিল, নাসিরুদ্দিন শাহ। চলচ্চিত্রটি সেরা শিল্প দিকনির্দেশনার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার জিতেছে। সামাজিক রীতিনীতির সাহসী সমালোচনাকারী হিসাবে উল্লেখযোগ্য ছবিটি।

সুরজ কা সাত্বভা ঘোড়া (১৯৯২) এক পুরুষের জীবনে বিভিন্ন সময়ে আসা তিন নারীর গল্প নিয়ে নির্মিত ছবিটি। অভিনয় করেছেন – রজিত কাপুর, নিনা গুপ্তা, রাজেশ্বরি সাচদেব, অমরিশ পুরী। হিন্দিতে সেরা ফিচার ফিল্মের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার জেতে ছবিটি।

জুবেইদা (২০০১) প্রেম এবং ট্র্যাজেডির নিয়ে লেখা কাহিনী ‘জুবেইদা’ তার আকাঙ্ক্ষা এবং সামাজিক প্রত্যাশার মধ্যে ধরা একজন মহিলার গল্প বলে। খালিদ মোহাম্মদের লেখা এবং কারিশ্মা কাপুর অভিনীত ছবিটি হিন্দিতে সেরা ফিচার ফিল্মের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার জিতেছে।

ওয়েলকাম টু সজ্জনপুর (২০০৮) কৌতুক সিনেমা ‘ওয়েলকাম টু সজ্জনপুর’ এক গ্রামীণ জনজীবনকে চিত্রায়িত করে। সিনেমায় শ্রেয়াস তালপাডের অভিনয় চর্চিত হয়েছে। আকর্ষক আখ্যান এবং সম্পর্কিত চরিত্রগুলির জন্য প্রশংসিত হয়েছিল ছবিটি।

ওয়েল ডান আব্বা (২০১০) দুর্নীতি ও আমলাতন্ত্রকে নিয়ে এই মজাদার ব্যঙ্গাত্মক সিনেমাটি চিত্রিত হয়েছে। মুখ্য ভূমিকায় রয়েছেন বোমান ইরানি। সিনেমাটি সামাজিক ইস্যুতে সেরা চলচ্চিত্রের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার জিতেছে।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version