তপন মল্লিক চৌধুরী

ভূত থাক আর না থাক,আমাদের বিশ্বাস কিংবা সংস্কারে কিন্তু মিশে আছে ভূতের অস্তিত্ব এবং তাদের ক্রিয়াকর্ম। ভূতে যেমন বিশ্বাস আছে তেমনই বাংলা সাহিত্যেও ভূতেরা সস্মমানে জায়গা নিয়ে আছে। কিছুকাল আগে পর্যন্ত গ্রামবাংলায় ভূতকে ঘরের একজন হিসেবেই ভাবা হত। ‘কদিন ধরে ওটা বড় উত্তক্ত করছে’- এমন কথা অনেক গৃহকর্তাকেই বলতে শোনা যেত। কেবল তাই নয়, কিভাবে ওটা উত্তক্ত করছে; তার ধরণও গৃহকর্তা ব্যাখ্যা করে জানাতেন, মাছ ভাজার সময় রান্নাঘরের জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে নাকি স্বরে অনুনয়-বিনয় করে ভাজা মাছ খেতে চায়। এসব কথা বলতে শুনতে গ্রামবাংলার মানুষ খুব যে একটা ভয় পেত; তা কিন্তু নয়।

বাংলা সাহিত্যেও যারা ভূত নিয়ে গল্প লিখেছেন তাঁরা হয়ত ছোটদের কথা ভেবেই ভূত নিয়ে ভয় দেখাননি। গল্পে ভূতের আসা-যাওয়া, চলা-ফেরা, ওঠা-বসা বা তাদের কর্মকাণ্ড একটা গা ছমছমে পরিবেশ তৈরি করলেও তা থেকে ছোটরা ভয় পেয়েছে বা তাদের কাণ্ডকারখানায় ভূতের গল্পে একেবারে উৎসাহ হারিয়েছে এমনটা মনে হয় হয়নি। বরং খুব মজাই পেয়েছে। বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ছোটদের জন্য প্রচুর লিখেছেন, যার মধ্যে ভূতের গল্প তো একটা বিরাট জায়গা নিয়ে আছে। তিনি যে সত্যি ভূতে বিশ্বাস করেন তা নিজেই কবুল করেন, ‘ভূতেরা আছে, আমি ভূতের অস্তিত্বে বিশ্বাস করি এবং তাদের ভয় পাই। আমার বইয়ের মতো তারা মোটেই মজার নয়।’ শীর্ষেন্দু মনে করেন, টেলিভিশনের এ যুগেও শিশুরা ভূতের গল্প পড়তে ভালোবাসে। বাংলা সাহিত্যের আরেক বিখ্যাত লেখক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ওরফে বনফুলও ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করতেন। শোনা যায়, তার বাড়িতে কেউ গেলে তিনি তাকে ভূতের গল্প শোনাতেন।

বাংলা কথা সাহিত্যিকেরা ভূতের পাশাপাশি পেত্নী বা মহিলা ভূতের কথাও বলেছেন।পেত্নী কথাটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ প্রেতনী; প্রেতের স্ত্রী লিঙ্গবাচক শব্দ থেকে। বাংলা গল্প অনুযায়ী পেত্নী যেকোনো মানুষের চেহারা ধারণ করতে পারে। ওরা থাকে শ্যাওড়া ও তেঁতুল গাছে। ওদের ট্রেডমার্ক হচ্ছে, পা উল্টোদিকে ঘোরানো থাকে।এছাড়া আছে শাকচুন্নি। এই কথাটিও এসেছে সংস্কৃত শব্দ শঙ্খচূর্ণী থেকে। এরাও মহিলা ভূত। গল্পেরবর্ণনা অনুসারে তার হাতে থাকে শাখা, যা হিন্দু বিবাহিত মেয়েরাই পড়েন। শাকচুন্নি সাধারণত বিবাহিত মেয়েদের ওপর ভর করে কারণ, তারা বিবাহিত জীবন উপভোগ করতে চায়। শাকচুন্নিরা সাধারণত সাদা বা লাল শাড়ি পড়েপুকুর বা দীঘির পাড়ে থাকে। বিবাহিত মেয়েরা পুকুর ঘাটে গেলে শাকচুন্নিরা তাদের ওপর ভর করে। পেত্নী কিংবা শাকচুন্নিদের অনেকে ‘চুরেল’ নামও দিয়েছেন।

বাংলা গল্পে যত রকম ভূত পাওয়া যায় তাদের মধ্যে আছে বেঁশোভূত।বেঁশো কথাটি এসেছে বাঁশ থেকে।এই ভূতেরা বাঁশঝাড়ে বাস করে। এদের ভয়েই মানুষ সন্ধ্যার পর বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে যেতে চায় না। বাঁশঝাড়েদিনের বেলাতেও একটা গা ছম ছম করা ব্যাপার থাকে। হাওয়ায় বাঁশঝাড়ে যে শব্দ হয় তা যেন বেঁশোভূতেরই কারসাজি।

মেছোভূতের গল্প বাংলা সাহিত্যে প্রচুর। এই ভূতের কাজই হল মাছ খেয়ে ফেলা। তাই এরা পুকুর, দীঘি কিংবা নদীর ধারে থাকে। কিন্তু সরাসরি জল থেকে নয়, ওরা জেলেদের নৌকা থেকে বা মানুষের রান্নাঘর থেকেও মাছ চুরি করে খায়। এমনকিবাজার থেকে মাছ কিনে ফেরার পথে মানুষমেছোভূতের পাল্লায় পড়ে। মোছোভূত ভয় দেখিয়ে থলি থেকে মাছ কেড়ে নেয়।

সুন্দরবনের ভূতের গল্পে পাওয়া যায়বেঘোভূত। বেঘো মানে বাঘ। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আক্রমণে যেসব মানুষ মারা যায় তারা বেঘো ভূত হয়ে যায়। যারা সুন্দরবনে মধু বা কাঠ সংগ্রহের কাজে যান তাদেরকে এই বেঘোভূত ভয় দেখায় এবং পথ ভুলিয়ে বাঘের সামনে নিয়ে যায়। বেঘোভূত বাঘের গর্জন করেও গ্রামের মানুষকে ভয় দেখায়।

বাংলা গল্পে গাছে থাকা গেছোভূত আরমামদো ভূত খুবই জনপ্রিয়। পাশাপাশি মাথাবিহীন ভূতদের কথাও আছে। এই ভূত স্কন্ধকাটা বা কবন্ধ নামেও পরিচিত।দুর্ঘটনায় মাথা কেটে যারা মার যান, তাদের আত্মাই এই ভূত হয়ে যায়। এরা নিজেদের হারানো মাথা খুঁজতে গিয়েই মানুষকে আক্রমণ করে।

বাংলা গল্পে এক ধরণের ভূত মানুষকে পথ ভুলিয়ে ঘোরের মধ্যে ফেলে অচেনা জায়গায় নিয়ে যায়। রাতের বেলা গাঁয়ের পথে এই ভূতদের দেখা মেলে। এদের কারসাজিতে মানুষ একই পথে বারবার ঘুরতে থাকে। এছাড়া আরেক ধরণের ভূতের দেখা মেলে যারা চেনা মানুষের গলায় নাম ধরে ডেকে ঘরের বাইরে নিয়ে যায়। এরা বাংলা গল্পের ক্ল্যাসিক ভূত-নিশি, খুবই ভয়ানক ভূত। এভাবে যারা নিশির ছলনার জালে আটকে যায়, তারা নাকি আর কখনো ফিরে আসে না, নিজেরাই নিশি হয়ে যায়।

Share.

3 Comments

  1. ঠিকই, ভূত তো একরকম নয়, এত রকম ভূতের গল্প আমরা ছোটবেলায় পড়েছি কিন্তু তাদের কথা আলাদা করে ভাবিনি।

  2. swapan kumar sanyal on

    ভূত আসলে কল্পনা, ভূত ভাবতে বেশ রোমাঞ্চ লাগে, রহস্য দানা বেঁধে ওঠে। থাক আর না থাক ভূতের কল্পনা তো আছে।

  3. arpita sengupta on

    বাংলায় ভূত কি কম পড়িয়াছে? দর্জিপাড়ার গাবগাছ তলায় এক এক ভূত বিশ রুপাইয়া

Leave A Reply

Exit mobile version