একসময় যুদ্ধক্ষেত্রের প্রধান অস্ত্র ছিল তীর-ধনুক এবং তরবারি। তখন যোদ্ধারা সম্মুখ যুদ্ধে তরবারি ব্যবহার করতেন এবং দূর থেকে তীর ছুঁড়তেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো যুদ্ধে তীর-ধনুক কিংবা তরবারির কথা ভাবাই যায় না। কারণ, আধুনিক যুগের উন্নত সব মারণাস্ত্র, বন্দুক, ট্যাংক, বোমারু বিমান, গ্রেনেড ইত্যাদির কাছে মধ্যযুগীয় অস্ত্রগুলি নিতান্তই ছেলেখেলা। অদ্ভুত হলেও সত্য যে, এক যোদ্ধা সত্যি সত্যিই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তীর, ধনুক এবং তরবারি ব্যবহার করেছেন। তিনি হলেন জর্জ ম্যালকম থর্প ফ্লেমিং চার্চিল। তাঁর অদ্ভুত এই স্বভাবের জন্য তিনি ‘ম্যাড জ্যাক’ নামেও পরিচিত হয়েছিলেন।
স্যান্ডহার্স্টের রয়াল মিলিটারি অ্যাকাডেমি থেকে গ্র্যাজুয়েশন করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়ার আগে তিনি কাজ করতেন নাইরোবি সংবাদপত্রের সম্পাদক হিসেবে। তিনি একাধারে ছিলেন একজন মডেল এবং সিনেমা অভিনেতা। তীর-ধনুকে পারদর্শী হওয়ায় তিনি ‘দ্য থিফ অব বাগদাদেও‘ ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন। সেই একই পারদর্শিতার জন্য তিনি নরওয়ের ওসলোতে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রিটেনের পক্ষে তীরন্দাজ হিসেবে অংশগ্রহণও করেছিলেন। ইতিমধ্যে গোটা ইউরোপ দ্রুত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যায়। প্রায় ১০ বছর সেনাবাহিনীতে থাকার পর নাগরিক জীবনে ফিরে আসা ম্যাড জ্যাক ফের সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। কারণ, তাঁর ভাষায় “দেশটি তার অনুপস্থিতিতে একটি যানজটে আটকে গিয়েছে”! ২য় বিশ্বযুদ্ধের আগে ম্যাড জ্যাক পদাতিক সেনাবাহিনীর সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হন এবং সবসময় যুদ্ধক্ষেত্রে তার তীর-ধনুক নিয়ে অগ্রসর হতেন। সঙ্গে থাকতো তার অতি বিশ্বস্ত তরবারি। যদিও তার অস্ত্রগুলো ছিল অনেকটাই সেকেলে, তবুও কেউ যদি তার ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো এবং তার এই অদ্ভুত স্বভাবের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন তুলতো, তখনো তিনি নিজেকে সংযত করতেন এটা বলে, “আমার মতে, তরবারি ছাড়া যেকোনো অফিসারের যুদ্ধের পোষাকই অসম্পূর্ণ!”
তিনি মধ্যযুগীয় অস্ত্রগুলো যে প্রসাধনীরূপে ব্যবহার করতেন তা কিন্তু নয়। তিনি সেগুলোর সঠিক ব্যবহারও করেছেন। যেমন, ‘ব্যাটল অব ডানকার্ক’-এ প্রায় ৩ লক্ষ সৈন্য সমুদ্রসৈকতে আটকা পড়েছিলো। খুব দ্রুত তাদের সেই স্থান থেকে সরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। ঠিক সেই সময় চার্চিল এক জার্মান সৈন্যকে ধরাশায়ী করেছিলেন শুধুমাত্র তার তীর-ধনুকের নিপুণ দক্ষতায়। তার পরেই দেখা যায়, তিনি একটি মোটরসাইকেল নিয়ে ফিরে আসছেন। পাশে ছিল তার প্রিয় তীর-ধনুক। সেই সঙ্গে একজন জার্মান অফিসারের ক্যাপও লাগানো ছিল মোটরসাইকেলটির হেডলাইটে ঝুলন্ত অবস্থায়! এরপর জার্মানির নরওয়েতে ‘অপারেশন আর্চারি’ নামের একটি আক্রমণে তিনি দুটি সেনাদলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তবে এই আক্রমণে তিনি নিজস্ব তীর-ধনুক ব্যবহার করেছিলেন কিনা সে ব্যাপারে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে তিনি তরবারিটি ব্যবহার করেছিলেন বলে জানা যায়। পরবর্তীতে ম্যাড জ্যাক ছিলেন সালেরনোর কমান্ডিং অফিসার। তখন তাঁর সৈন্যদেরকে বাধ্য করা হয়েছিল সম্মুখযুদ্ধ করতে, যে ধরনের যুদ্ধে তার সৈন্যদল মোটেও প্রশিক্ষিত এবং প্রস্তুত ছিল না। অবস্থা বেগতিক দেখে চার্চিল তার তরবারি হাতে সৈন্যদলের একদম সামনে চলে যান। হুট করেই অন্ধকার থেকে বের হয়ে জার্মান প্রহরীদের সামনে আত্মপ্রকাশ করেন। তীর-ধনুক সঙ্গে ব্যাগপাইপ কাঁধে এবং উন্মুক্ত তরবারি হাতে ভোজবাজির মতো উদয় হওয়া এমন এক অদ্ভুত ‘মানব’কে দেখে জার্মান সৈন্যরা এতটাই ভয় পেয়ে যায় যে, তারা আত্মসমর্পণ করে! সেই রাতেই চার্চিল তাঁর এক সৈন্য এবং নিজস্ব বিশ্বস্ত তরবারির সাহায্যে মোট ৪২ জন জার্মান সৈন্যকে আটক করেছিলেন।
এরপর চার্চিলকে যুগোস্লাভিয়াতে পাঠানো হয়। সেখানকার ভিস দ্বীপমালায় তিনি জার্মানদের বিরুদ্ধে কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেন। ম্যাড জ্যাকের উপর একটি দলের নেতৃত্বের দায়িত্ব পড়ে। কিন্তু তাঁর অভিযানের লক্ষ্যে অর্থাৎ পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছায় মাত্র ৬ জন। সেখানে পৌঁছে ম্যাড জ্যাক দেখলেন, তাঁরা এমন একটি ফাঁকা জায়গায় এসে পৌঁছেছেন, যার চারপাশে শুধুই শত্রু। অর্থাৎ শত্রুদের সহজ নিশানায় পরিণত হয়েছেন তিনি ও তার মুষ্টিমেয় সৈন্যরা। এমন অসহায় পরিস্থিতিতে তিনি ‘উইল ইউ নো কাম ব্যাক এগেইন’ এর সুর তুলে তার ব্যাগপাইপ বাজাতে শুরু করলেন! একটু পরই জার্মান সৈন্যদের ছোঁড়া গ্রেনেডে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন এবং তাঁকে আটক করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের পর তাঁকে জাকজেনহাউজেন বন্দীশিবিরে রাখা হয়। জার্মানদের বিশ্বাস, তিনি ছিলেন উইন্সটন চার্চিলের খুব ঘনিষ্ঠ কোনো আত্মীয়! যেহেতু তার নামের শেষটাও ছিলো চার্চিল। এছাড়াও তাকে সেনাবাহিনীর উচ্চশ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে কয়েদখানায় বন্দী করা হয়। তবে ম্যাড জ্যাক মোটেই জেলে পড়ে থাকার মতো মানুষ ছিলেন না। তিনি কাঁটাতারের বেড়ার নিচের পুরনো নর্দমার নালা দিয়ে চুপিচুপি পালিয়ে যান। তবে তার বেশ কিছুদিন পরেই তিনি ও তাঁর একজন সহযোগী ফের গ্রেফতার হন এবং তাকে অস্ট্রিয়ার একটি ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অস্ট্রিয়ার সেই ক্যাম্পের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটলে চার্চিল সুযোগের সদ্ব্যবহার করে পালিয়ে গিয়ে হাঁটতে থাকেন। প্রায় ৮ দিন পর ১৫০ মাইল দূরে আমেরিকার একটি অস্ত্রগাড়ির সামনে পড়ে যান। তার অদ্ভুত বেশভূষার জন্য সমস্যায় পড়লেও তিনি তাদেরকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, তিনি একজন ব্রিটিশ অফিসার। ফলে তিনি নিরাপদে ফিরতে সক্ষম হন। সামরিক বাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর যুদ্ধপাগল ম্যাড জ্যাক মৃত্যুবরণ করেন।