অর্পণ বর্ধন
অবশেষে সম্পূর্ণ হলো ঝালমুড়ির বৃত্ত। শনিবার তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিলেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা আসানসোলের বিজেপি সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেকের উপস্থিতিতে দলবদল করেছেন তিনি। যিনি মাসকয়েক আগেও ‘ভাইপোর’ বিরুদ্ধে নিয়মিত তোপ দাগতেন। আর শনিবার বারবেলায় তাঁর হাত ধরেই সোজা পদ্ম শিবির থেকে ঘাস ফুল শিবিরের অন্দরে ঢুকে পড়লেন। শেষ হলো গত কয়েক মাসের টানটান মহা নাটকের। শনিবার ক্যামাক স্ট্রিটের অফিসে বাবুল সুপ্রিয়র হাতে তৃণমূলের পতাকা তুলে দেন স্বয়ং সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এই মাহেন্দ্রক্ষণে উপস্থিত ছিলেন ডেরেক ও’ব্রায়েনও।
গত ৩১ জুলাই বাবুল সুপ্রিয় ফেসবুকে লিখেছিলেন, চললাম আলবিদা। অবশ্য বাবুল এও বলেছিলেন, রাজনীতি না করলেও সমাজসেবায় দেখা যাবে তাঁকে। তবে তিনি চাইলেও রাজনীতি কি তাঁকে ছেড়ে যেতে চাইছে না? তা অবশ্য সময় বলবে। বাবুল যোগ দিচ্ছেন তৃণমূলের ট্যুইটার হ্যান্ডেল থেকে এই টুইট সামনে আসতে না আসতেই ট্যুইটটি শেয়ার করে ডেরেক ও’ব্রায়েন লিখেছেন, “খেলা হবে”।
প্রসঙ্গত, শুক্রবার সন্ধ্যা বেলায় বাবুল সুপ্রিয় নিরাপত্তা কমানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল কেন্দ্রের তরফে। ঘোষণা করা হয় বাবুলকে ওয়াই ক্যাটাগরির নিরাপত্তা দেওয়া হবে। জল্পনা চলছিল তখন থেকেই। আর শনিবার সমস্ত জল্পনার অবসান ঘটিয়ে বাবুল যোগ দিলেন তৃণমূলে। এদিন বাবুলকে তৃণমূল পরিবারে অভ্যর্থনা জানান স্বয়ং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। দিন কয়েক আগেই বাবুল সুপ্রিয়কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাড়িতেও দেখা গিয়েছিল। বাবুল সেই ঘটনাকে সৌজন্যই বলেছিলেন।
সুপ্রিয় বড়াল। এটাই বাবুল সুপ্রিয়র আসল নাম ৷ গানের জগতে আসার পর নাম বদলে বাবুল সুপ্রিয় রাখেন। গানের জগতে যথেষ্ঠ জনপ্রিয় বাবুল সুপ্রিয়। তাঁর রাজনীতিতে আসা ২০১৪ সালে ৷ লোকসসভা নির্বাচনে আসানসোল কেন্দ্র থেকে বিজেপি প্রার্থী হিসাবে জয়ী হন ৷ এরপরই কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রীর পদ পান। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে ফের জয়ী হন ৷ এবারও প্রতিমন্ত্রীরৃ পদই ভাগ্যে জোটে ৷ বিনোদন জগতের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও বাবুল নেমেছিলেন রাজনীতির ময়দানে। প্রথম থেকে না হলেও যত সময় গড়িয়েছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ঝাঁঝ বাড়িয়েছিলেন বাবুল। কটাক্ষ করেছিলেন একাধিক হেভিওয়েট নেতা মন্ত্রী থেকে শুরু করে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তবে এও ঠিক বহুবার মমতা ও বাবুলের “সৌজন্যের রাজনীতির” ছবি দেখেছে রাজ্যবাসী। সে কলকাতার রাস্তায় ঝালমুড়ি খাওয়াই হোক বা রাতে রাস্তায় গাড়ি খারাপ হওয়ায় মমতা নিজের গাড়িতে বাবুলকে লিফট দেওয়াই হোক; ভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য হলেও সৌজন্য বিনিময়ে কখনও কোনও কার্পণ্য করেন নি দুজনেই। আর সেকারনে বারবার প্রথম থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন বাবুল সুপ্রিয়।
গত আগস্ট মাসে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতির সঙ্গে বৈঠক করে বাবুল সুপ্রিয় জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি আর রাজনীতিতে থাকবেন না। কিন্তু তার মানে যে তৃণমূল গমন তা অতি বড় রাজনীতিবিদও বুঝতে পারেননি। তবে রাজ্য বিজেপির সঙ্গে বাবুলের দূরত্ব বাড়ছিল দীর্ঘদিন ধরেই। সম্প্রতি নরেন্দ্র মোদী মন্ত্রীসভার সম্প্রসারণ করলে সেখানে বাবুলের ঠাঁই হয়নি। তাতে অভিমান করে বাবুল রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেন। যদিও অমিত শাহ, জে পি নাড্ডাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার কথা বলেছিলেন তিনি। তাতে অনেকে মনে করছিলেন বাবুল ক্ষমতাচ্যুত হলেও অন্য জার্সি গায়ে গলাবে না। কিন্তু বদলে গেলো সব সমীকরণ।
উল্লেখ্য ভবানীপুরে বাবুল ঘনিষ্ঠ প্রিয়াঙ্কা টিব্রিওয়ালকে প্রার্থী করেছে বিজেপি। রাজনৈতিক মহল মনে করছে ঠিক ভবানীপুর উপনির্বাচনের আগে সেই বাবুলকেই তুলে নিয়ে বিজেপিকে কিস্তিমাত করলো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। যেহেতু ভবানীপুরে বাবুল ঘনিষ্ঠ প্রিয়াঙ্কাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে প্রার্থী তাই স্টার ক্যাম্পেনার বা তারকা প্রচারক হিসেবে বিজেপি ভবানীপুরে বাবুলের নাম রেখেছিল। বাবুল তখনই জানিয়ে দেন প্রচারে যাবেন না তিনি।
তবে শনিবার তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়। তিনি সাফ জানান, বাংলার হয়ে কাজ করার জন্য সামনে ‘বড় সুযোগ’ এসেছে। তাই তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিয়েছি। আমি কাজ পাগল। আশা করছি দল আমাকে যে দায়িত্ব দেবে তা পালন করতে পারব। তৃণমূলে যোগ দিয়ে আমি গর্বিত। সঙ্গে তিনি বলেন, মমতাদিদি ও অভিষেক যে দায়িত্ব আমায় দিচ্ছেন, তাতে আমি অত্যন্ত উৎসাহিত। বাবুল সুপ্রিয় জানান, সোমবার তিনি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করবেন।
কিন্তু কেন হঠাৎ বিজেপি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন বাবুল? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি সাংবাদিকদের জানান, সাত বছর ধরে যে কঠিন পরিশ্রম করছিলেন তাতে ফুলস্টপ পড়ে যাচ্ছিল। ধুলোয় মিশে যাচ্ছিল তাঁর সমস্ত পরিশ্রম। পাশাপাশি বিজেপির সাংসদ পদও ছেড়ে দিতে পারেন তিনি, এমনটাই ইঙ্গিত দেন সাংসদ। ভবানীপুরে মমতার হয়ে প্রচারে কী বাবুল থাকছেন? এই বিষয়ে তিনি বলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কারও প্রচারের প্রয়োজন নেই। তবে আমি একটি দলে যোগদান করেছি। দল যা বলবে সেই নির্দেশ মোতাবেক কাজ করব।
এদিকে গেরুয়া শিবির ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পরই বাবুল সুপ্রিয়কে একসুরে আক্রমণ করেন বঙ্গ বিজেপি নেতৃত্ব। বিজেপির রাজ্যসভার সদস্য স্বপন দাশগুপ্ত বলেন, তৃণমূলে যোগ দেওয়ার জন্য বাবুল সুপ্রিয় বিজেপি ছেড়েছেন জেনে আমি দুঃখিত। ভবিষ্যতের কথা জানি না। তবে বিজেপির সম্পদ ছিলেন তিনি। তাঁর এতদিনের কাজের জন্য ব্যক্তিগতভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। যাঁদের কাছে বিজেপি আজীবনের, তাঁদের লড়াই জারি আছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও থাকবে।
বিজেপি নেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায় টুইট করে বলেন, সম্ভবত বাংলার বিজেপি সমর্থকদের মধ্যে মানসিক অস্থিরতা তৈরি করতেই এমন মিথ্যা ছবি প্রকাশ করা হচ্ছে।
জয়প্রকাশ মজুমদার বলেন, বাবুল সুপ্রিয় বরাবরই সংগীত জগতের সোক। এন্টারটেইনমেন্টের লোক। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে দলে এসেছিলেনন। মন্ত্রী হয়েছেন। সাংসদ হয়েছেন। একুশের নির্বাচনে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। মন্ত্রীত্ব থেকে বাদ পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সুর বদলেছেন। আর সেই বেসুরো বাবুলই নতুন সুর খুঁজে পেয়েছেন তৃণমূলে। এক্ষেত্রে আদর্শগত প্রশ্ন উঠছে।
শমীক ভট্টাচার্য বলেন, বাবুলের বিজেপি ভালো লাগেনি। মন্ত্রী হওয়াই লক্ষ্য ছিল তাঁর।
বিজেপি নেতা অনুপম হাজরা টুইট করে বলেন, তার মানে ঝালমুড়ির রফা আগেই হয়ে গিয়েছিল। শুধুমাত্র অপেক্ষা করা হচ্ছিল কীভাবে রাজ্যসভাতে পাঠানো যায়। তাই হয়তো অর্পিতা দেবীকে রাজ্যসভা ছেড়ে থিয়েটারে মন দিতে বলা হলো।
রুদ্রনীল ঘোষ বলেন, বাবুল সুপ্রিয় তৃণমূলে যেতে পারেন তা ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। আসলে শিল্পী বাবুলকে চিনতাম। রাজনীতিক বাবুলকে সেভাবে চেনার সুযোগ হয়নি।