“আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর / থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর”। পরিবেশ ও প্রকৃতিকে নিয়ে লেখা এই কবিতা পড়ে আগে তাঁকে শুধু শিশুতোষ কবি ভাবতাম। তাঁর নাম মনে এলেই মনের কোণে এখনো এই দুটি লাইন ভেসে ওঠে। তিনি গ্রাম বাংলার বিগত শতকের সারা-জাগানো বিরল প্রতিভাবান কবি। শিশু সাহিত্যিক হিসেবে বেশি পরিচিত হলেও তিনি সাহিত্যিক, চিত্রকর, গীতিকার, নাট্যকার ও সাংবাদিক। ছোটদের কাছে তিনি গল্প দাদু বলে খ্যাত।
বাংলাদেশের পাবনা জেলার রাধানগর গ্রামের নারায়ণপুর মহল্লায় এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর ছোটবেলা কেটেছে গ্রামীন পরিমন্ডলে। তাঁর মা ছিলেন শিক্ষানুরাগী। ছোট থেকে তিনি মায়ের মুখে গল্প ও রূপকথা শুনে বড় হয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন তাঁর সাহিত্য প্রতিভার জন্য তাঁর মায়ের অবদান ছিল অনেক। নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় তাঁর প্রথম কবিতা “ছিন্নপত্র” প্রকাশিত হয় “বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি গেজেট”-এ।
ছোটবেলা থেকে তাঁর ছবি আঁকার প্রতি ভীষণ আকর্ষণ ছিল। প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বাবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি হয়ে তিনি কলকাতার ‘ইন্ডিয়ান আর্ট একাডেমি’-তে ভর্তি হন। চিত্রকলার পাঠ নেওয়ার সময় তিনি বেলিয়াঘাটায় ৩নং তাঁতিবাগান লেনে একটি পরিবারে পেইং গেস্ট হিসেবে ছিলেন। আর্ট একাডেমিতে চিত্রকলা শেখার পাশাপাশি নিজের লেখা কবিতা ও গল্প নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকার অফিসে অফিসে ঘুরতেন। ইন্ডিয়ান আর্ট একাডেমি থেকে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে করটিয়া সাদাত কলেজে ভর্তি হয়ে কিছুদিন এফ-এ পড়েছিলেন। কিন্তু সেখানেও বেশিদিন পড়াশোনা না করে ফের কলকাতায় চলে আসেন। ইতিমধ্যে তিনি কিছুদিন ইসলাম দর্শন পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি কলকাতা করপোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। কলকাতা থাকাকালীন তিনি বরাহনগরের কাশীনাথ দত্ত লেনে ভাড়া বাড়িতে থাকতেন।
জীবিকা নির্বাহের জন্য তিনি নানা ধরণের কাজ করতেন। চাকরি, পড়াশোনা, শিক্ষকতা ও সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় চিত্রকর ও ব্লক কোম্পানির ডিজাইনার হিসেবে কাজ করতেন। কলকাতা করপোরেশন স্কুলে শিক্ষক থাকাকালীন তিনি ‘কিশোর পরাগ’, ‘শিশু বার্ষিকী’, ‘জ্ঞানের আলো’ প্রভৃতি মাসিক পত্রিকার সম্পাদনা করতেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস “বসন্ত জাগ্রত দ্বারে” এবং প্রথম কাব্য-গ্রন্থ “ময়নামতির চর”। “ময়নামতির চর” পড়ে মুগ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে চিঠি লেখেন। সেই চিঠি পেয়ে তাঁর লেখালেখির প্রতি উৎসাহ আরও বেড়ে যায়। পেয়েছিলেন। এরপর “অনুরাগ” নামে তাঁর আরও একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
দীর্ঘ তিরিশ বছর কলকাতা বসবাসের পাট চুকিয়ে দেশভাগের পর তিনিফের তাঁর স্বদেশে অর্থাৎ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যান। কলকাতাতে থাকার সময়েই তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, কাজী নজরুল, জলধর সেন, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সরলাদেবী প্রমুখের সঙ্গেসম্পর্ক গরে উঠেছিল। পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে গেলেও কলকাতার সঙ্গে সেই বন্ধন অটুট ছিল। বন্দে আলী মিয়ার কোনো সম্পর্ক ভেঙে যায়নি। তাঁর জীবনে সেই সম্পর্ক জীবন ভোর অটুট ছিল।
ঢাকায় থাকাকালীনও তিনি বই লিখে, ছবি এঁকে, বেতার কেন্দ্রে অনুষ্ঠান করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। পাশাপাশি তিনি গ্রামাফোন কোম্পানির জন্য পালাগান ও নাটিকা রচনা করতেন। পরবর্তীতে তিনি রাজশাহী বেতার কেন্দ্রের শিশুদের আসরের জন্য গল্প ও রূপকথা রচনার স্ক্রিপ্টস্ রাইটার পদে নিযুক্ত হন। তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রাজশাহীতে ছিলেন। ছোটদের জন্য রেডিওতে প্রচারিত হতো ‘সবুজ মেলা’ নামে এক অনুষ্ঠান। কবি শিশুদের মন ভরাতে “সবুজ মেলা’ নামে অনুষ্ঠানকে আরও আকর্ষণীয় করতে নিজেই শিশুদের উপযোগী গল্প শুনিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করতেন। যার ফলে বেতারে প্রচারিত অনুষ্ঠানটি দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল। “ছেলে ঘুমালো” শীর্ষক অনুষ্ঠানে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় সহজ-সরল ভাষায় শিশুদের উপযোগী করে তাঁকে লিখতে হত নতুন গল্প এবং গান। প্রতিদিন এই ভাবে লেখা একজন বিরল প্রতিভাবান মানুষের পক্ষেই সম্ভব।ছোটদের জন্য লেখা তাঁর বইয়ের সংখ্যা ১০৫।
তাঁর উপন্যাসগুলির মধ্যে উল্লেখ করতে হয়-শেষ লগ্ন, দিবা স্বপ্ন, নারী রহস্যময়ী, ঝড়ের সংকেত, বসন্ত জাগ্রত দ্বারে, অস্তরাগ, অরণ্য গোধূলি, বয়সের দাবী, নীড়ভ্রষ্ট, অস্তাচল, মনের ময়ূর, ঘূর্ণি হাওয়া। কাব্য গ্রন্থ- ময়নামতির চর, পদ্মা নদীর চর কথিকা,অনুরাগ, লীলা সঙ্গিনী, মধুমতির চর, লীলাকমল, দক্ষিণ দিগন্ত, ক্ষুধিত ধরিত্রী। নাটক- জোয়ার ভাঁটা, মসনদ, জয় পরাজয়, বৌদিদির রেস্টুরেন্ট, গাধা হাকিম, যুগ সূর্য, বাঞ্ছারাম ঢ্যাং, উদয় প্রভাত। গানের বই-সুরলীলা,কলগীতি।শিশু সাহিত্যে অনন্য অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান১৯৬২-তে, রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পান ১৯৬৫-তে, এমনকিমরণোত্তর একুশে পদকেও ভূষিত হয়েছেন। কিন্তু এরপরও বন্দে আলী মিয়ার কথা আমরা মনে রাখিনি, তার জন্মদিন পালন তো দূরের কথা সেই দিনটিও আমরা জানি না।