স্টার থিয়েটার তৈরি হলেও তার সঙ্গে নিজের নাম জড়িয়ে না থাকায় তিনি কতটা আঘাত পেয়েছিলেন, তা আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন নটী বিনোদিনী। এরপর কেটে গিয়েছে ১৪১ বছর। ঊনবিংশ শতকের বাংলা মঞ্চের বিখ্যাত অভিনেত্রী বিনোদিনী দাসীর নামে স্টার থিয়েটারের নামকরণের জন্য অতীতে বারবার দাবি উঠেছে। কিন্তু তা আমলে নেওয়া হয়নি। অবশেষ দাবি পূরণ হল। জানা যায়, ১৪১ বছর আগে ১৮৮৩ সালে উত্তর কলকাতায় তৈরি হয়েছিল স্টার থিয়েটার। সে সময় নাট্যব্যক্তিত্ব গিরিশচন্দ্র ঘোষ বিনোদিনীকে স্টার থিয়েটার তৈরির টাকা জোগাড় করতে অনুরোধ করেছিলেন। বলা হয়েছিল, তাঁর নামেই রাখা হবে থিয়েটারের নাম। বিনোদিনী তাঁর ভক্ত গুর্মুখ রায়ের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা তুলে তা দিয়েছিলেন স্টার থিয়েটার তৈরির জন্য। সেই টাকায় শুরু হয় থিয়েটার তৈরির কাজ। থিয়েটার উদ্বোধনের কয়েক সপ্তাহ আগে বিনোদিনী জানতে পারেন যে তৎকালীন কলকাতার ‘ভদ্র সমাজের’ আপত্তির কারণে বিনোদিনীর নামে থিয়েটারটির নাম রাখা সম্ভব হচ্ছেনা। অর্থ দিয়েও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নিজের নামে থিয়েটারের নাম না রাখায় আঘাত পেয়েছিলেন অভিনেত্রী বিনোদিনী দাসী। বিষয়টি ‘প্রতারণা’ ও ‘বঞ্চনা’র মনে হয়েছিল অভিনেত্রীর, যে কথা তিনি তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার কথা’য় লিখেছিলেন।

তবে বিধান সরণির হাতিবাগানের আজকের প্রেক্ষাগৃহটি নটি বিনোদিনীর স্টার নয়। সেই স্টার থিয়েটারের ঠিকানা ছিল ৬৮ নম্বর বিডন স্ট্রিট। বর্তমান সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ও বিডন স্ট্রিটের উত্তরদিকের সংযোগস্থলে ছিল মঞ্চটি। জমিটি ছিল কীর্তি মিত্রের। সেটি ইজারা নিয়ে একটি থিয়েটার গড়ে তোলার টাকা দিয়েছিলেন হোরমিলার কোম্পানির ‘বেনিয়ান’ গণেশদাস মুসাদ্দির ছেলে গুর্মুখ রায়। তবে তাঁর একটি শর্ত ছিল, বিনোদিনীকে তাঁর আশ্রিতা হতে হবে। বিনোদিনী প্রথমে রাজি হননি। নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র ঘোষ হাতে ধরে তৈরি করেছিলেন তাঁকে। তাঁর অনুরোধে শেষপর্যন্ত রাজি হন। গুর্মুখ বিনোদিনীর হাতে তুলে দেন ৫০ হাজার টাকা। তখন স্থির হয়েছিল নাট্যশালার নাম হবে ‘বিনোদিনী থিয়েটার’, নিদেনপক্ষে ‘বি থিয়েটার’। কিন্তু, দাশু নিয়োগী, অমৃতলাল বসু, অমৃত মিত্র এবং গিরিশচন্দ্র ঘোষ রেজিস্ট্রি করতে গিয়ে তা পাল্টে করলেন ‘স্টার থিয়েটার’। কারণ, গিরিশবাবুর যুক্তি ছিল, ‘বারাঙ্গনা’ অভিনেত্রীর নামে থিয়েটার হলে সামাজিকভাবে বাধা আসবে। বিনোদিনী এই ব্যথা কখনও ভুলতে পারেননি। ১৮৮৩ সালের ২১ জুলাই গিরিশচন্দ্রের ‘দক্ষযজ্ঞ’ নাটক দিয়ে উদ্বোধন হয়েছিল প্রেক্ষাগৃহটির। নাট্যাচার্য ছিলেন দক্ষের ভূমিকায়। সতী হয়েছিলেন বিনোদিনী। মাত্র চার বছর টিকে ছিল সেই স্টার। বিনোদিনীও সেখানে অভিনয় করেছিলেন আর মাত্র তিন বছর। দলাদলি ও অপমানের কারণে ১৮৮৭ সালে ‘বেল্লিকবাজার’নাটকে রঙ্গিণীর ভূমিকায় অভিনয় করে বাংলা রঙ্গমঞ্চ থেকে বিদায় নেন তিনি। ইতিমধ্যে  ১৮৮৪ তে ‘চৈতন্যলীলা’র অভিনয় দেখতে এসে কুশীলবদের আশীর্বাদ করে যান দক্ষিণেশ্বরের রামকৃষ্ণ।

এর কিছুদিন পরে স্টার থিয়েটারও বিক্রি হয়ে যায়। ৩০ হাজার টাকায় স্টার থিয়েটার কেনেন গোপাললাল শীল। তিনি ওই প্রেক্ষাগৃহে ‘এমারেল্ড থিয়েটার’ নামে নতুন নাট্যদল গঠন করেন।সেটিও অবশ্য বেশি দিন চলেনি। এরপর নানা হাত বদল হয়ে এক সময়ে তার নাম হয় ‘মনমোহন থিয়েটার’। অন্য দিকে প্রেক্ষাগৃহ বিক্রির টাকায় হাতিবাগানের ৭৫/৩, কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে ত্রিশ কাঠা জমি কেনা হয়। অনেকেই হাল ছেড়ে দিলেও গিরিশচন্দ্র কিন্তু নাট্য জগতেই রয়ে যান। এমারেল্ড থেকে বোনাস হিসেবে পাওয়া ২০ হাজার টাকা থেকে ১৬ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করলেন স্টারের নতুন বাড়ি তৈরির কাজ। নতুন থিয়েটারের জন্য ‘নসীরাম’ নামে নতুন একটি নাটকও রচনা করেন তিনি। ১৮৮৮ তে মহা সমারোহে ‘নসীরাম’ নাট্যাভিনয় দিয়ে উদ্বোধন হয় নতুন প্রেক্ষাগৃহের। পুরনো মঞ্চটি সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ তৈরির সময় ভাঙা পড়ে। পারিবারিক চাপে গুর্মুখ থিয়েটারের স্বত্ত্ব ছেড়ে দিতে বাধ্য হলে মাত্র ১১ হাজার টাকার বিনিময়ে স্টারের মালিক হন অমৃতলাল বসু, অমৃতলাল মিত্র, হরিপ্রসাদ বসু ও দাসুচরণ নিয়োগী।

স্টারে কেবল থিয়েটার নয়, ১৮৯৭-এ অভিনয়ের পরিবর্তে দেখান হল মিস্টার সুলিভানের ‘animatograph’। বাংলা থিয়েটারে সেই প্রথম বায়োস্কোপের প্রদর্শন। ১৮৯৮ থেকে সিনেমা দেখানো আরম্ভ করে স্টার থিয়েটার। এই ধারা বজায় ছিল দীর্ঘ কাল। বাংলা রঙ্গমঞ্চের ধারাবাহিক অভিনয় বর্ণনা পাওয়া যায় ১৯১৯ সাল পর্যন্ত। ওই তালিকা থেকে জানা যায় যে ওই সময়ে স্টার থিয়েটারে মাঝে মধ্যেই বায়োস্কোপ প্রদর্শিত হত। যদিও প্রেক্ষাগৃহটি তৈরি হয়েছিল পেশাদার থিয়েটারের প্রয়োজনে। গিরিশ ঘোষের ‘নসীরাম’থেকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘ঘটক বিদায়’ পর্যন্ত প্রথম পর্বের একশো তিন বছরের ইতিহাসের পুরোটাই পেশাদারি থিয়েটারের ইতিহাস। এই শতাধিক বছরে ৮০ বা তারও বেশি বিশিষ্ট নাট্যকারের লেখা প্রায় ২৫০টি নাট্যপ্রযোজনা মঞ্চস্থ হয়েছে স্টার থিয়েটারে। ১৯৯১ সালের ১২ অক্টোবর ভয়াবহ এক অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত হয় ঐতিহ্যমণ্ডিত স্টার। কলকাতা পুরসভা সেটিকে আবার নতুন করে গড়ে তোলে। প্রায় তেরো বছর পর পুনর্নির্মিত স্টার থিয়েটারের দ্বিতীয় পর্ব আরম্ভ হয় ২০০৪-এর অক্টোবরে। পরিকাঠামোর অভাব ও অন্যান্য কারণে সেখানে নিয়মিত ভাবে নাটক মঞ্চস্থ করতে না পারায় শেষমেশ সিনেমা প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নেয় পুর-কর্তৃপক্ষ। সিনেমা দেখানো শুরু হয় ১ নভেম্বর, ২০০৬ থেকে।

সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ তৈরির সময়ে ১৯২৮ সালে সেই ‘স্টার’ভাঙা পড়লেও বিনোদিনী আর স্টার নাম দুটির মাহাত্ম্য এমনই যে, পরবর্তী কালে হাতিবাগানের স্টার থিয়েটারের সঙ্গেও মানুষ বিনোদিনীর স্মৃতি সংযুক্ত করে এসেছেন। সেই স্টারের সঙ্গে এত দিনে জুড়ল বিনোদিনীর নাম।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version