কলকাতা ব্যুরো: ভারতের সংবিধানে বর্ণিত সকলের জন্য শিক্ষার অধিকার কি এবার বাস্তবেই পণ্য হতে চলেছে, এ রাজ্যে সরকারের হাত ধরে? রাজ্যের গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে দেশের একটি বৃহত্তর শিল্পগোষ্ঠীর হাতে দেওয়ার কানাঘুষোয় সেই প্রশ্নই এখন সবচেয়ে বড় হয়ে উঠেছে। যদিও শাসকের তরফে একে স্কুলশিক্ষা ব্যবস্থা আরও আধুনিকিকরণের পথ বলে, প্রচারের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, এবার শিল্পপতিদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে স্কুল গড়বে রাজ্য সরকার। এ বিষয়ে একটি খসড়াও তৈরি হয়েছে। জানা গিয়েছে, পিপিপি মডেলে চলবে স্কুলগুলি। স্কুলশিক্ষা দপ্তর এ বিষয়ে একটি গাইডলাইনও তৈরি করেছে। নয়া ব্যবস্থায় সরকারি এবং বেসরকারি স্কুলগুলি ‘মার্জ’ হয়ে যাবে।

রাজ্য সরকার ইতিমধ্যে ২৯০০ স্কুলকে মাধ্যমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে উন্নীত করেছে। প্রতিবছর সরকারের অধীন স্কুলগুলি থেকে গড়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয় ১২ লক্ষ এবং উচ্চমাধ্যমিক দেয় ৯.৫ লক্ষ পড়ুয়া। এত বিশাল সংখ্যার ছাত্র-ছাত্রী সর্বোচ্চ সমমানের পঠন-পাঠনের সুযোগ পায় না। সরকারের অব্যবহৃত পরিকাঠামো এবার সেই কাজে ব্যবহৃত হবে। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ মডেলে চলবে স্কুল। জমি ও পরিকাঠামো সরকারের। প্রশাসনিক দেখভালের দায়িত্বে থাকবে বেসরকারি সংস্থা।
তবে কোন মাধ্যমে স্কুল চলবে তা ঠিক করবে সেই বেসরকারি সংস্থা অর্থাৎ স্কুলটি বাংলা, নাকি হিন্দি নাকি ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা চলবে তা ঠিক করবেন লগ্নিকারী। তাঁরাই হবেন শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিয়োগকর্তা। সমগ্র শিক্ষা অভিযানের প্রকল্প অধিকর্তা, স্কুলশিক্ষা দপ্তরের কমিশনারের প্রতিনিধি, অর্থ দপ্তরের প্রতিনিধি ও আইন দফতরের প্রতিনিধি নিয়ে একটি কমিটি গঠিত হবে। কমিটি গোটা বিষয়টি নজরদারি করবে।

যেভাবে রাজ্যে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ধীরে ধীরে বেসরকারি ও কর্পোরেটরা স্বাস্থ্যের একটা বিশাল অংশ রাজ্যে দখল করে নিয়েছে, এবার শিক্ষাও সেই পথেই পণ্য হচ্ছে কিনা, সেই বিতর্ক আগামী দিনে আরও বড় আকার নেবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। ফলে নূন্যতম শিক্ষার অধিকার গরীব গুর্বরা, পাবে কিনা, তাও ভাবাচ্ছে শিক্ষাবিদদের। ফেলো করি, মাখো তেল প্রবাদ শিক্ষার ক্ষেত্রে আগামী দিনে বড় হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখছেন বুদ্ধিজীবীদের একাংশ। যদিও এত সহজে শিক্ষা পুরোপুরি বেসরকারিদের নিয়ন্ত্রণে যাবে না বলেই আশাবাদী বুদ্ধিজীবীদের একাংশ। তারা বলছেন, সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকবে।

যদিও পাল্টা যুক্তি, যেভাবে এখন বেসরকারি স্বাস্থ্যের উপরে খাতায়-কলমে নিয়ন্ত্রণ থাকলেও বাস্তবে তা কার্যকর হয় না, তেমনই খাতায়-কলমে নিয়ম তৈরি হবে কিনা সেই প্রশ্নই বড় হয়ে উঠছে। তা ছাড়া শিক্ষার মৌলিক অধিকার, এই মডেলে নাগরিকদের দেওয়া সম্ভব কিনা সংশয় রয়েছে তা নিয়েও। ফলে সবার জন্য শিক্ষার স্লোগান আগামী দিনে ঠাণ্ডা ঘরে যাবে কিনা তা নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

অধ্যাপকদের সংগঠন আবুটার (ABUTA) বক্তব্য, কেন্দ্রীয় সরকারের মতো রাজ্যও এবার কর্পোরেট গোষ্ঠীর স্বার্থে শিক্ষার বেসরকারিকরণের পথে হাঁটতে চলেছে। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক গৌতম মাইতি বলেন, এতদিন মুখে জাতীয় শিক্ষানীতির বিরোধিতা করার পর রাজ্য যে খসড়া প্রকাশ করেছে তা পুরোপুরি জাতীয় শিক্ষানীতির (২০২০) আদলে। পিপিপি মডেলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অর্থ সরকার জনগণের শিক্ষার সব দায়িত্ব থেকে হাত গুটিয়ে নিতে চাইছে। এর পরিণতিতে সরকারি অর্থায়নে শিক্ষার যেটুকু সুযোগ সাধারণ বাড়ি থেকে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে আছে তাও আর থাকবেনা। যার টাকা আছে সেই কেবল শিক্ষার সুযোগ পাবে।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version