বিগত কয়েক বছরে পুরুলিয়া থেকে পিংলা, কালিয়াচক থেকে খাগড়াগড়, নৈহাটি, বর্ধমানের রসিকপুর বাংলার প্রায় সর্বত্র রাজনীতি ঘিরে নানা ধরণের হামলা, বিস্ফোরণ, সন্ত্রাস, খুন ঘটেই চলেছে। তবে সম্প্রতি রামপুরহাটের বগটুই গণহত্যা ছাপিয়ে গিয়েছে সব ঘটনাকেই। তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে উপপ্রধান খুনের জেরে শিশু ও মহিলা-সহ১০ জনকে আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় যখন গোটা দেশ কেঁপে উঠেছিল তখন আশ্চর্যজনক ভাবেই চুপ করেছিল বাংলার বুদ্ধিজীবীরা। প্রশ্ন উঠেছিল, কেন তাঁরা নীরব? 

সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের ঘটনার পরও যারা অনেকেই এসএসসি-তে স্বচ্ছ নিয়োগের দাবিতে সরব হয়েছিলেন, নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষক পদপ্রার্থীদের স্বচ্ছ নিয়োগের দাবিতে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখে স্কুল সার্ভিস কমিশনের মেধা তালিকা অনুযায়ী নিয়োগের দাবি করেছিলেন, তাঁরা কিভাবে বগটুই-এর ঘটনার পর নীরবে নিশ্চিন্তে দিন কাটাচ্ছেন তা নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন উঠেছিল। ওঁদের চুপ থাকা নিয়ে ঝড় উঠেছিল নেটদুনিয়ায়। অনেকেই বলেছিলেন, এদের প্রত্যেকের জীবনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদান রয়েছে, এরা প্রত্যেকেই তৃণমূল ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত।

এক সময় বোমা মজুত ঘটনার প্রতিবাদে কবীর সুমন কন্ঠছেড়ে গেয়েছিলেন- “বাহবা সাবাস বড়দের দল এই তো চাই / ছোটরা খেলবে আসুন আমরা বোমা বানাই।” অথচ সেই তিনি বগটুয়ের ঘটনায় জানিয়ে দেন,‘‘মার্জনা করবেন৷ আমি কোনো ব্যাপারে কোনো মত দেবো না৷ আপনার মঙ্গল হোক৷’’ প্রতিবাদমুখর কবি সুবোধ সরকারের বলেন, ‘‘আমি তো এখন কবিতা উৎসবে৷বিষয়টা আমি জানিও না৷ বলতে পারবো না৷ রামপুরহাটে কোথায়? কখন ঘটলো?আমাকে বিষয়টা দেখতে হবে৷’’ টলিউডের অভিনেতা অভিনেত্রীরা ‘‘শুটিংয়ে ব্যস্ত, শটের মধ্যে রয়েছেন, পরে কথা বলবেন ইত্যাদি প্রভৃতি বলে এড়িয়ে যান। মুখ্যমন্ত্রী মমতার বিরুদ্ধে একদা গর্জে ওঠা পরিচালক অনীক দত্ত মূল বক্তব্যকে পাশ কাটিয়ে জানান, ‘‘বুদ্ধিজীবী শব্দটিই তো খারাপ শব্দ৷ এই বাংলায় গালিগালাজের সমান৷’’ চিত্রকর শুভাপ্রসন্ন জানান, ‘‘এটা একটা ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা৷ মানুষের মৃত্যু কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়৷ তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে রাজ্যে অনেক কিছু ভালো হচ্ছে৷ নানারকমভাবে বিরোধীরা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে৷’’

তার মানে সবাই যে চুপ করেছিলেন বা পাশ কাটিয়ে গিয়েছেন; সেটা পুরোপুরি সত্যি নয়, রাজপথে কেউই প্রতিবাদে নামেননি বা গলা ফাটাননি সেকথা বলা যাবে না, কারন পবিত্র সরকারের মতো ভাষাবিদকেও মিছিলে হাঁটতে দেখা গিয়েছে। কিছুদিন আগে স্টুডেন্টস এগেনস্ট ফ্যাসিজম-এর ব্যানারে প্রতিবাদ মিছিলেও পা মেলাতে দেখা গিয়েছিল শহরের অনেক বিশিষ্টজনদের।কিন্তু যারা বাম জমানার অন্তিমকালে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঘটনার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলেন এবং পরিবর্তনের বাংলায় মমতার ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন, উল্লেখ্য আনিস খান হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে পূর্ব বর্ধমানের তুহিনা খাতুনের আত্মহত্যা, ঝালদায় কংগ্রেস কাউন্সিলর তপন কান্দু আর পানিহাটিতে তৃণমূল কাউন্সিলর অনুপম দত্তের খুন এবং বগটুই-এর ঘটনার পরও রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে তাঁরা উদ্বেগ প্রকাশ তো দূরের কথা, অদ্ভুত নীরবতা পালন করলেন। এতে বঙ্গবাসী অবাক হয়েছিলেন, তাঁদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন

এই অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিলেন বিশিষ্টজনেরা।তাঁরা রামপুরহাট হত্যাকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কেন এমন একটি ঘটনা রুখতে পুলিশ প্রশাসন আগে থেকে তৎপর হল না? তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সেই সঙ্গে প্রশ্ন তোলা হয়েছে আমতার ছাত্রনেতার মৃত্যু ও সেই সঙ্গে দুই কাউন্সিলরের হত্যা নিয়েও। মুখ্যমন্ত্রীকে লেখা সেই খোলা চিঠিতে সই করেছেন মোট ২২ জন। অনেক দেরিতে হলেও বাংলার বুদ্ধিজীবীদের সিদ্ধান্তে নিশ্চয় রাজ্যের বিরোধী শিবির খুশি। কিন্তু বিরোধিদের খুশিতে কেন তাঁরা এতদিন নীরব ছিলেন, কেন এতদিন তাঁদের বোধদয় হয়নি-এই সাধারণ প্রশ্নগুলি একেবারেই গুরুত্ব হারায় না বরং আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বগটুই-এর ঘটনা অতি সাম্প্রতিককালের হলেও রাজ্যের আইন–শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেকদিন আগেই ভেঙে পড়েছে, রাজ্যের শাসকদলের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে লাগাতার দুর্নিতির অভিযোগ উঠছে, শাসকদলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে প্রায়শই হিংসা, খুন লেগেই আছে-এসব ঘটনায় আম জনতার মনে আশঙ্কা সৃষ্টি হলেও রাজ্যের বুদ্ধিজীবীরা সরব হওয়া তো দুরের কথা সরকারের প্রতি কোনও প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেননি। তবে কি তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীকে না চটিয়ে তাঁর আস্থাভাজন থাকতে চান?

এ ব্যাপারে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের মত, বঙ্গের বামেদের প্রতি অবিশ্বাস ও বিতৃষ্ণা এখনও এতটাই প্রবল যে বুদ্ধিজীবীরা তাদের উপর আস্থা রাখতে পারছেন না, অন্যদিকে রাজ্যে হিন্দুত্ববাদীদের রুখতে শাসকদলের উপর থেকে এখনই সমর্থন তুলে নেওয়া যাচ্ছেনা। অন্যদিকে আরেক দলের মত, অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীরা এখনো মুখ্যমন্ত্রীর সুনজরে রয়েছেন, আচমকা কোনও ঘটনার প্রেক্ষিতে তাঁরা সেই নিশ্চিন্ত ছায়াতলটি হারাতে যাবেন কেন? তাই বগটুই গ্রামে নৃশংস হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিশিষ্টজনেরা চিঠিতে রাজ্য পুলিশ প্রশাসেনর বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দিলেওমুখ্যমন্ত্রী নিজে বগটুই গ্রামে গিয়ে নিহতদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাঁদের আর্থিক সাহায্য দেওয়ার পাশাপাশি ও নিহতদের পরিবারের একজনকে চাকরির আশ্বাস দিয়েছেন- মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই পদক্ষেপগুলির প্রশংসা করেছেন।
Share.

2 Comments

  1. sanghamitra bhattacharya on

    বিষয়টা মোটেও ঘুম ভাঙা বা বোধদয়ের নয়, বিষয়টা সম্পূর্ণতই অঙ্কের, ২০১১ থেকেই বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তথা শাসকদলের সুপ্রিমো বাংলার বুদ্ধিজীবি বা ওই জাতীয় সরকারি
    স্তাবকদের টিকি তাঁর পায়ে বেধে রেখেছেন। বঙ্গ বুদ্ধিজীবী তথা বিশিষ্টজনদের গতি প্রকৃতি এখনও পর্যন্ত সরকার তথা শাসকদলের অঙ্গুলিচালনার উপরেই নির্ভরশীল। তারা
    মুখ্যমন্ত্রীর বড় আপনজন। মুখ ফস্কে প্রশাসনের সমালোচনা করলেও মুখ্যমন্ত্রীর বিপক্ষে কিছুতেই নয়।

  2. bivash chakrabarty on

    বাংলার বুদ্ধিজীবী বা বিশিষ্টজনেরা চিরকালই সরকারের সুনজরে থাকতে পছন্দ করেন, ফলতঃ তারা কখনোই সরকারকে চটাতে চান না বরং চাটতেই সুখানুভব করেন। যারা সেদিন সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের ঘটনায় মিছিলে হেঁটেছিলেন সেদিন বাম সরকারের অন্তিম মুহুর্ত, কিন্তু তার আগে বুদ্ধ বাবুর কথায় নাটক বন্ধ রেখেছিলেন যে বিশিষ্টজন তিনিই আবার মমতার প্রিয়জন হয়েছিলেন। এমন উদাহরণ অগুনতি, ব্যতিক্রম হাতে গোনা। বগটুই-এর পর মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠিতে পুলিশের ভূমিকার নিন্দা আর মমতার ভূমিকার প্রশংসা জানাতে সময় লেগেছে অঙ্ক কষোতে। চিঠি লেখার পর কি বিশিষ্টজনেরা মুখ্যমন্ত্রী বা শাসকদলের অপ্রিয় হচ্ছেন বা অনুদান পাবেন না সিনেমা-নাটক-কবিতা…র জন্য?

Leave A Reply

Exit mobile version