গত সংখ্যার পর

দিব্যি মানুষ এই গোঁসাইজী। সেই কোন্ ছোটবেলা থেকেই গাঁ ঘুরে বেড়ায় সে। পাহাড়তলির আশ্রমে গুরুগোঁসাই মনোহর দাসের দেহান্তর হলে আশ্রমের সব দায়িত্ব ‌এখন তার উপরেই‌। মনোহর বাবার ভক্ত শিষ্য, সাধু বাউলের দল সারা বছরই আসা যাওয়া করে। মেলা মোচ্ছবে আশ্রম জমে ওঠে কয়েকটি দিনের জন্য। এছাড়া দোল, রাস সহ অন্যান্য তিথি ধরেও উৎসব অনুষ্ঠান হয়ে থাকে এখানে। পাশাপাশি গাঁয়ের মানুষজনও একাত্ম হয়ে ওঠে উৎসবের ক’দিন। তারাই থাকে মূল আয়োজক হিসেবে। সমস্ত দায়িত্ব পালন করে সমবেত ভাবে।

নিত্যদিনের মতো সকালেই চান সেরে রাধা গোবিন্দের শ্রীচরণে ফুল জল নিবেদন করে গোঁসাইজী বেরিয়ে পড়ে পাহাড়তলীর দু’চারটে গ্ৰাম ঘুরতে। মাধুকরীর জন্য উদাসী বাউলের ভরাট গলায় সুর ওঠে পদাবলী কীর্তনের। রামী চন্ডীদাসের আখ্যান কিম্বা মান মাথুর, বানখন্ড, তাম্বুলখন্ড থেকে নির্বাচিত পদগুলোকে কীর্তনাঙ্গের সুরে যখন গেয়ে ওঠে তখন গাঁয়ের সব মানুষই মোহিত হয়ে শোনে। একটি ভাবের আবেশ এনে দেয় সকলের মনে। ডুবিয়ে দেয় গৌড়ীয় ভক্তিরসের ধারায়।

গোঁসাইকে পেয়ে তাদের ঠেসনা, ঝামটা শুরু হয়ে গেল নিজেদের মধ্যে। নিজেদের মানে চার পাঁচজন- চুনারি, তিনজন-চিঁড়েকুটুনি আর একজন শাঁখারিণী ও একজন বেলমালাওয়ালী। এদের সঙ্গে আর একজনের কথা না বললেই নয়। যার পাথর কুঁদে শরীর গড়া, তার নাম মদন। এ তল্লাটের লোক তাকে মদনা বলেই ডাকে। তার বাবা মা সে বছর মথুরা, বৃন্দাবন ঘুরে এসে ঠাকুরের দয়ায় সন্তান পেয়েছিল। তাই তার নাম রেখেছিল- মদনমোহন। মদনের কাজ হলো পাহাড়ের খাদান থেকে পাথর কেটে নিচে নামানো। বাছাই করা এই পাথর দিয়ে মূর্তি, থালা, বাটি, গ্লাস এমনকি ঘর গেরস্থালির সামগ্ৰী বানানো হয়। শিল্পীদের কাছে মদনের বিরাট কদর। সে নিজেও একজন জাতশিল্পী। ওর আর একটা বড়ো গুণের কথা বলতেই হয়। আড়বাঁশি বাজানোয় মদনের জুড়ি মেলা ভার। মোহন বাঁশিতে সুর যখন জাগে তখন কত শত মানুষ মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ে। পাড়া ঘরের দু’চারজন মদন বানে জর্জরিত হয়ে পড়ে। শিলাইজোড়, ধ্বতলা, হেঁসলা ছাড়াও আশে পাশের গাঁয়ের হরিবাসরেই হোক কিম্বা পালা কীর্তনের আসরে মদনের অনিবার্য ডাক আসে বাঁশিদার হিসেবে।

গোঁসাইজী খঞ্জনি বাজিয়ে গুণগুণ করে সুর ভাঁজে। মদন বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে সুর তোলে। হঠাৎই সুর চড়িয়ে গোঁসাইজী গেয়ে ওঠে- না পোড়ায়ো রাধার অঙ্গ / না ভাঁসায়ো জলে গো / মরিলে তুলিয়া রাখো / তমালেরো ডালে গো…!

রাঢ়াশ্রয়ী রাগ ও সুরে পরপর গেয়ে চলেছে গোঁসাইজী। মদনের বংশী ধ্বনি মাতাল করে তুলেছে বন, পাহাড় আর গ্ৰাম জনপদকে। চৈতি হাওয়ায় মেতে উঠেছে গোটা পাহাড়তলী। যেন অন্য কোনও ভূবন অন্য কোনও মায়ালোক। সুরের অনুরণন মিশে যায় পাহাড়ে। প্রান্তভূমির শাল মহুয়া পলাশের ডালপালায়। চারণভূমিতে মন দিয়ে ‌গরু চরানোয় ব্যাস্ত রাখাল। আপ্রান চেষ্টা করে চলেছে বাঁশিতে সুর তোলার। সেই সম্মিলিত গান, বাঁশির সুর ভেসে যায় চারপাশে।

পারমার্থিক থেকে জাগতিক আবহে ফিরছে চরাচর। শুরু হয় আবার পথচলা। দিবাকর ক্রমশ ঢলে পড়ছে দিগন্তের কোলে। গাঢ় হয়ে উঠবে বন পাহাড় আর পাহাড়তলীর ছোট ছোট গ্ৰাম জনপদ। বেহাগ রাগে সুর জেগে উঠবে গোটা শুশুনিয়া পরিমন্ডলে।

দেখতে দেখতে বেলা গড়িয়ে যায়। পাহাড়,নদী,মাঠ জুড়ে চুঁইয়ে পড়ে অন্ধকার। যমুনা, কালিন্দী ও কদমতলা ছেড়ে ফিরে চলেছে যে যার ঘরে। মদনের পাথর বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য মোটর ভ্যান এসে গেছে। গোঁসাইজী লম্বা লম্বা পায়ে ফিরতে চলেছে আশ্রমে। নিত্য সেবা হয় রাধা গোবিন্দর। সকালেই বাল্যভোগ নিবেদন করে বেরিয়ে পড়ে গোঁসাইজী। অন্ন ভোগ রান্না করে রাখে আশ্রমে ঠাঁই পাওয়া আনন্দময়ী দাসী। সন্ধ্যেয় ভোগ আরতির পর লন্ঠন হাতে আনন্দময়ী ফিরে আসে গ্ৰামে। তার নিজের গাঁ নয়। দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের ঘরে ঠাঁই পেয়েছে তাদের কুলদেবতার সেবা কাজের জন্য। গাঁয়ের সবাই সমীহ করে রূপলাবণ্যময়ী এই অকাল বিধবা যুবতীটিকে। বিয়ে হওয়ার এক বছরের মাথায় স্বামী মারা যায় দূরারোগ্য ব্যাধিতে। কেউ কেউ কপালের দোষ, বিধাতার লিখন বলে চালিয়ে দেয়। বাপের বাড়িতে ফিরে এলে কিছুদিন পর শোকের আবহ কাটতে না কাটতেই ভাই, দাদাদের সংসারে তাকে নিয়ে শুরু হল চরম অশান্তি। অনেক ছোট বেলায় মাকে হারিয়েছে সে। বিয়ের পরপরই তার বাবাও আচমকা পাড়ি জমায় পরপারে। অথৈ জলে পড়ে যায় আনন্দময়ী। কয়েকদিন পর সুরাহা করে দিলেন তাদেরই আত্মীয় হরিহর চাটুয্যে। শিলাইজোড় আশ্রমে ঠাকুরের ভোগরান্না ও সেবা কাজের জন্য একজন দায়িত্বশীল মহিলা দরকার। হরিহর বাবু লোক মারফত খবর দিলে আনন্দময়ীর ভাই আশ্রমে নিয়ে আসে তার দিদিকে। এতো ভালোবাসা এতো হাসি খুশির সংসার ছেড়ে বৈধব্য জীবন কাটাতে আসতে হলো আশ্রমে। এই ছিল আনন্দময়ীর বিধির লিখন! ছোটবেলার গাঁয়ের সহপাঠী রাজারাম ছিল আনন্দময়ীর অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। মাঝপথে সংসারের জন্য লেখাপড়ায় ইতি টানতে হয় আনন্দময়ীকে। তাছাড়া গাঁয়ের লোকজন ও আত্মীয় স্বজনের বক্তব্য ছিল, বেশি লেখা পড়া করাতে নেই মেয়ে মানুষকে। রাজারাম আরও উঁচু ক্লাসে পড়ার জন্য চলে গেলো আসানসোলে। সেখানে তার মামার বাড়ি। কালে ভদ্রে গাঁয়ে আসতো সে। আচমকা একদিন আনন্দময়ীর বিয়ের খবর পেয়ে এসেছিল গ্ৰামে। রাজারামের প্রতি ভরসা ছিল তার। সুখদুঃখের কথা জানানোর একটি বিশ্বাস যোগ্য মাধ্যম ছিল সে। সেই কোন্ আম কুড়োনোর বেলা থেকেই গাঢ় বন্ধুত্ব ছিল তাদের। আনন্দময়ী ক্রমশ রাজারামের প্রতি একটুখানি বেশিই অনুরক্ত হয়ে পড়ছে। তখনই মাথা চাড়া দিল জাতপাতের প্রশ্ন চিহ্ন। উঁচু ব্রাম্হণ পরিবারের মেয়ে সে।  তার উপর কৌলিন্য শ্রেষ্ঠ পরিবারের মেয়ে হয়ে চাষা ঘরের ছেলের সঙ্গে মেলামেশা? অনিবার্য ভাবে লক্ষ্মণরেখা টানা হলো আনন্দময়ীর জন্য। তার কাকা কাকিমা বলে উঠলো, যুগের হাওয়া ভালো নয়। বড় দাদা নিদান দিল- ঠ্যাঙ খোঁড়া করার।

(চলবে)  

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version