বাইবেল অনুযায়ী, দু’হাজার বছরের আগে মাতা মেরির গর্ভে জন্মেছিলেন যিশু। মেরি ছিলেন ইসরাইলের নাজারেথবাসী যোসেফের বাগদত্তা। ধর্মপ্রাণ এই মানুষটি পেশায় ছিলেন কাঠমিস্ত্রি। একদিন এক স্বর্গদূতের কাছ থেকে মরিয়ম জানতে পারেন, মানুষের মুক্তির পথ দেখাতে তার গর্ভে আসছেন ঈশ্বরের পুত্র। দূত শিশুটির নাম যিশু রাখার নির্দেশ দেন। স্বর্গদূতের এই কথা শুনে বিচলিত হন মেরি। তিনি তাকে বলেন, ‘স্বামীর শারীরিক স্পর্শ ছাড়াই তিনি কীভাবে সন্তানের জন্ম দেবেন।’ স্বর্গদূত মেরিকে বলেন, ‘ঈশ্বরের পবিত্র আত্মা তার ওপর অবস্থিতি হবে এবং তার প্রভাবেই মেরি গর্ভবতী হবেন এবং তার ছেলে হবে। স্বর্গদূতের কথা মেরি আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেন এটা জেনে যে, তখনকার ইহুদি নিয়ম অনুযায়ী কুমারী অবস্থায় গর্ভধারণ করায় তাকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করা হতে পারে। মেরির হবু স্বামী যোসেফ যখন জানতে পারেন মেরি সন্তানসম্ভবা, তখন তাকে আর বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ঈশ্বরের দূত স্বপ্নে তাকে দেখা দিয়ে বলেন, মেরি গর্ভবতী হয়েছে পবিত্র আত্মার প্রভাবে এবং তার যে সন্তান হবে তা ঈশ্বরেরই পরিকল্পনা। যোসেফ যেন মেরিকে সন্দেহ না করে তাকে গ্রহণ করেন। তখন যোসেফ দূতের কথামতো মেরিকে বিয়ে করেন, কিন্তু সন্তান জন্ম না নেওয়া পর্যন্ত তাকে শারীরিকভাবে স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকেন।

এদিকে মেরির সন্তান প্রসবের সময় ঘনিয়ে এলে রোমান সম্রাট অগাস্টাস সিজার আদমশুমারী করেন। তিনি নির্দেশ দেন যার যার পিতৃপুরুষদের শহরে গিয়ে নাম লিপিবদ্ধ করতে হবে। যোসেফের পিতৃপুরুষরা ছিলেন যিহূদিয়ার বেথলেহেমের। যোসেফ তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী মেরিকে নিয়ে নাম লেখাতে সেখানে যান। কিন্তু নাম লেখাতে প্রচুর লোক আসায় তারা থাকার জন্য কোনো জায়গা পেলেন না। পরে একজন লোক তাদের গোয়ালঘরে থাকতে দিলেন। সেখানেই মেরি সন্তান প্রসব করেন এবং কাপড়ে জড়িয়ে যে পাত্রে খেতে দেওয়া হয় তাতে রাখলেন। স্বর্গদূতের কথামতো যোসেফ শিশুটির নাম যিশু রাখলেন। যিশুর জন্মের সময় বেশ কয়েকটি অলৌকিক ঘটনা ঘটে। ওই সময়ে মাঠে ভেড়া চরানো রাখালদের কাছে গিয়ে স্বর্গদূত যিশুর জন্মের খবর দেন। বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী রাখালরা তখনই যিশুকে দেখতে যান এবং উপহার হিসেবে সঙ্গে নিয়ে যান একটি ভেড়ার বাচ্চা। প্রায় একই সময়ে আকাশে একটি উজ্জ্বল তারা দেখা যায়। যেটা দেখে কয়েকজন জোতির্বিদ ও পণ্ডিত বুঝতে পারেন যে, একটি বিশেষ শিশুর জন্ম হয়েছে। তারা অনেক খোঁজাখুঁজি করে যিশুকে দেখতে আসেন এবং স্বর্ণ ও সুগন্ধি দ্রব্য উপহার দেন।

এই ভাবে একের পর এক অলৌকিক ঘটনার মধ্য দিয়ে যিশু বড় হন এবং মানুষের মধ্যে মুক্তির বাণী প্রচার করেন। তিনি নিজেও অনেক অলৌকিক কাজ করেন, যার মধ্যে- জলকে আঙ্গুরের রসে রূপান্তর থেকে শুরু করে মৃত ব্যক্তিকে জীবন দানের মতো ঘটনার বর্ণনা বাইবেলে পাওয়া যায়।কিন্তু যিশুর শিক্ষা ও আশ্চর্য কাজ ইহুদি ধর্মগুরুদের ঈর্ষান্বিত করে তোলে এবং তারা রোমান শাসকদের কাছে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে ক্রুশে দিয়ে যিশুকে হত্যা করেন। বাইবেল অনুযায়ী এটাও ছিল ঈশ্বরের পরিকল্পনা। কারণ মৃত্যুর তিন দিন পর যিশু পুনরুত্থান করে স্বর্গে চলে যান। কিন্তু যিশুর শিক্ষা ও কাজে মোহিত হয়ে অনেকেই তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তার অনুসারীরা খ্রিস্টান নামে পরিচিতি পায়।

দু’হাজার বছর আগে যিশুর জন্ম হলেও বড়দিন পালন শুরু হয় অনেক পরে। এমনকি যিশুর শিষ্যরাও কখনো তার জন্মোৎসব পালন করেননি বা তার জন্মদিনকে ধর্মীয় উৎসবে রূপান্তর করেননি। শুরুর দিকে খ্রিস্টানদের ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে বড়দিন ছিল না। দ্বিতীয় শতাব্দীর দু’জন খ্রিস্ট ধর্মগুরু ও ইতিহাসবিদ ইরেনাউস ও তার্তুলিয়ান বড়দিনকে খ্রিস্টানদের উৎসবের তালিকায় যুক্ত করেন। ২০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে মিসরে প্রথম বড়দিন পালনের প্রমাণ পাওয়া যায়। গ্রিক কবি, লেখক ও ইতিহাসবিদ লুসিয়ান তার সময়ে ক্রিসমাস পালিত হত বলে উল্লেখ করেছেন। ২২১ খ্রিস্টাব্দে মিসরের একটি দিনপঞ্জিতে লেখা হয়েছিল, মাতা মেরি ২৫ মার্চ গর্ভধারণ করেন। এ বিষয়টি রোমান ক্যালেন্ডারেও ছিল। এই ক্যালেন্ডারে সূর্যদেবতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উৎসবের কথাও রয়েছে। সেই হিসাবে গর্ভধারণের নয় মাস পর ২৫ ডিসেম্বর যিশু জন্মগ্রহণ করেন বলে খ্রিস্টান ধর্মগুরুরা মত দেন।

ইতিহাসে রয়েছে, ৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে রোমে সর্বপ্রথম বড় আকারে বড়দিন উদযাপন শুরু হয় ‘স্যাটার্নালিয়া’ উৎসবকে কেন্দ্র করে। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য দেশেও। ৩৫৪ খ্রিস্টাব্দে রোমান পঞ্জিকায় ২৫ ডিসেম্বর যিশুর জন্মদিন উল্লেখ করে দিনটিকে যিশুর জন্মদিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী সময়ে ৪৪০ সালে পোপ একে স্বীকৃতি দেন। মধ্যযুগে বড়দিন উৎসব আরও জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ৮০০ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ডিসেম্বর জার্মানির রাজা রোমান সম্রাট হিসেবে গির্জা কর্তৃক মুকুট ধারণ করেন। ১০০০ খ্রিস্টাব্দে রাজা সেন্ট স্টিফেন হাঙ্গেরিকে খ্রিস্টান রাজ্য ঘোষণা করেন। ১০৬৬ খ্রিস্টাব্দে রাজা উইলিয়াম ইংল্যান্ডের মুকুট ধারণ করেন। ক্রিসমাস উৎসব প্রসারে এগুলো বেশ প্রভাব ফেলে। তবে প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কারের সময় একদল লোক বড়দিন পালনের বিরোধিতা শুরু করে। তাদের অভিযোগ, উৎসবটি পৌত্তলিক এবং ধর্মীয়ভাবে এর কোনো তাৎপর্য নেই। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইংল্যান্ডের গোঁড়া শাসকরা ১৬৪৭ সালে বড়দিন উৎসব পালন নিষিদ্ধ করে। অবশ্য একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর এই নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। বর্তমানে শুধু ক্যাথলিক নয়, প্রটেস্ট্যান্টসহ সব খ্রিস্টানই এই উৎসব পালন করেন।

ভারতে প্রথম ক্রিসমাস উদযাপিত হয় ১৬৬৮ সালে। কলকাতায় জব চার্ণক প্রথম বড়দিন পালন শুরু করেন বলে জানা যায়। ওই বছর হিজলি যাওয়ার পথে সুতানুটি গ্রামে আসার পর চার্ণক খেয়াল করলেন, বড়দিন এল বলে! সেখানেই যাত্রাবিরতি করে বড়দিন পালন করেন চার্ণক। সেই থেকে আমাদের দেশে বড়দিন পালিত হয়ে আসছে। তবে দুনিয়ার অধিকাংশ দেশে ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন পালিত হলেও রাশিয়া, জর্জিয়া, মিসর, আর্মেনিয়া, ইউক্রেন ও সার্বিয়ায় ব্যতিক্রম। জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের জন্য এই দেশগুলোতে ক্রিসমাস পালিত হয় ৭ জানুয়ারি। উত্তর ইউরোপীয়রা যখন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে তখন পৌত্তলিকতার প্রভাবে ক্রিসমাস শীতকালীন উৎসবের মতো পালন শুরু হয়। ফলে সেখানকার এ উৎসবে শীত উৎসবের অনুষঙ্গও যুক্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত স্ক্যান্ডিনেভীয়রা এ দিনটিকে ‘জুন’ উৎসব বলে থাকে।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version