কলকাতা ব্যুরো: অবশেষে শাসকদলের আশঙ্কাই সত্যি হলো। অর্থমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য কিছুটা বাজেট পড়ার পরই হট্টগোল শুরু করলো বিজেপি। তবে তাতে থামেননি তিনি। উত্তেজনার মাঝেই বেশ কিছুক্ষণ বাজেট পড়েন অর্থমন্ত্রী। এরপরই অধিবেশন ওয়াকআউট করে বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রীর লেখা কবিতা পাঠ করে বাজেট পেশ শেষ করেন চন্দ্রিমা।

 হাজারও আর্থিক প্রতিকূলতা, করোনা কালে কর্মক্ষেত্রের দুর্দশা, উৎপাদন শিল্পে মন্দা, কেন্দ্রের অসহযোগিতা সব সামলেও চলতি আর্থিক বর্ষে পশ্চিমবঙ্গের আয় বেড়েছে। রাজস্ব আদায় আগের অর্থবর্ষের তুলনায় ৩.৭৬ গুণ বৃদ্ধি হয়েছে। শুক্রবার বিধানসভায় রাজ্য বাজেট পেশের পর তা নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তুলে ধরলেন এমনই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। সামগ্রিকভাবে ‘জয় বাংলা’ বাজেট বলে একে ব্যাখ্যা করেন তিনি। জানালেন, সামগ্রিকভাবে ৮ গুণ বেশি বরাদ্দবৃদ্ধি হয়েছে। করোনা কালে যা যথেষ্ট প্রশংসনীয় বলেই মনে করছেন তিনি।

২০২২-২৩ অর্থবর্ষে বিধবাদের পেনশনে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। করছাড়ে মেয়াদবৃদ্ধি, পরিবহণ-সহ একাধিক ক্ষেত্রে কর মকুবের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এদিন রাজ্যের প্রথম মহিলা অর্থমন্ত্রী হিসেবে ১১২ পাতার বাজেট আংশিকভাবে পেশ করেন চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। তারপর অর্থদপ্তরের উপদেষ্টা অমিত মিত্রকে নিয়ে বাজেটের ব্যাখ্যা দেন মুখ্যমন্ত্রী।

২০২২২৩ অর্থবর্ষে রাজ্যের বাজেটের মূল ঘোষণা। কি বললেন মমতা? দেখুন একনজরে!

আমাদের অনেক প্রকল্প ইতিমধ্যেই চলছে। এমন কোনও সেক্টর নেই যেখানে প্রকল্প নেই। সেগুলি চলবে।

মোট বাজেট বরাদ্দ ৩.৮ গুণ বেড়েছে।

রাজস্ব আদায় ৩.৭৬ গুণ বেড়েছে। এত কোভিড, ইয়াস, আমফান সত্ত্বেও আমরা ৩.৩৬ গুণ বাড়াতে পেরেছি।

সোশাল সার্ভিস সেক্টরে বরাদ্দ ১০.৭ গুণ বেড়েছে।

কৃষি বিভাগে ৩৩.২ গুণ বেড়েছে বাজেট বরাদ্দ।

উচ্চ শিক্ষা দফতরের জন্য ২৫.৪ গুণ বাজেট বরাদ্দ বেড়েছে।

স্বাস্থ্য ও জনকল্যাণ বিভাগে ১৯.৩ গুণ বরাদ্দ বেড়েছে।

নারীকল্যাণে ১৭.৫ গুণ বেড়েছে।

কৃষকবন্ধু প্রকল্পে আমরা ৭০ লক্ষ কৃষককে সহায়তা দিচ্ছি।

লক্ষ্মীর ভাণ্ডার চালু রয়েছে।

সিএনজি চালিত গাড়িতেও একই অঙ্কে কর ছাড়ের প্রস্তাব। পরিবেশবান্ধব বৈদ্যুতিন গাড়ি শিল্পে উৎসাহ দিতে রেজিস্ট্রেশন ফি আর রোড ট্যাক্সে দু’ বছর ছাড়।

স্বাস্থ্যসাথীর সুবিধা সাড়ে ৯ কোটি মানুষ পাচ্ছেন, খাদ্যসাথীর সুবিধা পাচ্ছেন ১০ কোটি মানুষ।

আমরা যখন ক্ষমতায় আসি গ্রামবাংলার রাস্তা ছিল মাত্র ২৯ হাজার ৭০৬ কিমি। রাস্তায় বিপ্লব হয়ে গেছে। আমরা ১ লক্ষ ৩৪১ কিমি রাস্তা করেছি ১০ বছরে।

বিধবা ভাতায় অতিরিক্ত বরাদ্দ বাজেটে।

চা বাগানে কৃষি আয়ের উপর কর মকুব।

২০২৪ -এর মধ্যে সর্বত্র পানীয় জল।

জমি বাড়ি রেজিস্ট্রেশন ও স্ট্যাম্প ডিউটিতে ২ শতাংশ কর ছাড়ের মেয়াদ বাড়ল আরও ছ’ মাস।

আমরা কেন্দ্রীয় সরকারের উপর এখনও ৯০ হাজার কোটি টাকার মতো পাই। কথায় কথায় বলে কেন্দ্র দিচ্ছে। কোথা থেকে দিচ্ছে কেন্দ্র? এখান থেকে জিএসটির টাকা নিয়ে যাচ্ছে। অথচ আমাদের ভাগটাই আমরা পাচ্ছি না।

যারা বলে বেড়াচ্ছে ‘আনপ্ল্যান্ড অর্থনীতি’, আগামিদিন পেনশন পাবেন না! তারা মনে রাখে যেন, একমাত্র রাজ্য বাংলা যারা সরকারি কর্মীদের পেনশন দেয়। সোফায় বসে যারা জ্ঞান দেয় তাদের জানা দরকার, বিজেপির কোনও রাজ্য পেনশন দেয় না। চোরের মায়ের বড় গলা। মানুষের হাতে পয়সা দিলে অর্থনীতিটা সচল হয়। আমরা যেমন দিচ্ছি। আমার লোকপ্রসার শিল্পীরাও ভাতা পান, বিধবারা ভাতা পান, মেয়েরা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার পান, শ্রমিকরা পান। মানবিক ভাতা পান ফিজিকালি চ্যালেঞ্জড যাঁরা।

বানতলা লেদার ইন্ডাস্ট্রি গেটওয়ে হয়ে গেছে। ৫ লক্ষ ছেলেমেয়ের চাকরি হবে। কয়েক লক্ষ হয়েও গিয়েছে। সারা বাংলাজুড়ে কাজ হচ্ছে।

বন্যায় যাতে বাংলা না ভাসে তার জন্য পরিকল্পনা করে ৩ লক্ষের উপরে জলাশয় কেটেছি আমরা, চেকড্যাম তৈরি হয়েছে। কিন্তু বারবার কেন্দ্রকে বলা হলেও এখনও ডিভিসি একবারের জন্য ড্রেজিং করেনি।

ব্যাঙ্ক এমন জায়গায় চলে এসেছে, টাকা রাখবে মানুষ কিন্তু তা ফেরত পাবে কি না তাও জানে না। এমন পরিস্থিতি এসেছে। মানুষের সচল ভাগ্য অচল করে দেওয়া হয়েছে। ভোটযন্ত্র আর কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার জোরে, একনায়কতন্ত্রের জোরে কয়েকটা রাজ্যে জিতে লাফাচ্ছে। ২০২৪-এর বাজনা বাজাতে শুরু করেছে। ডুগডুগি বাজালে হবে না, সঙ্গে করতাল, ঘণ্টা, হারমোনিয়াম, তবলা, ভায়োলেন, তান, প্রাণ চাই। সব নিয়েই ২০২৪ আসবে।

আগামী দু’বছর পরে কে কোথায় থাকবে কেউ বলতে পারে না। দু’ বছর পর আমি বেঁচে থাকব কি না আমি বলতে পারব? অমিতদা বলতে পারবেন অমিতদা বেঁচে থাকবেন কি না, চন্দ্রিমা বলতে পারবে ও অর্থমন্ত্রী থাকবে কি না! ডেস্টিনি ইজ ডেস্টিনি। ডেস্টিনি আর ডেস্টিনেশনের মধ্যে পার্থক্য আছে।

বিজেপি বড় বড় ভাব করছে। বাজেটটা পর্যন্ত পড়তে দিচ্ছে না। আমি সাতবারের সাংসদ ছিলাম। আমি দু’টো জেনারেল রেল বাজেট, ৭-৮টা সাপ্লিমেন্টারি বাজেট পাশ করেছি। আমি কখনও এরকম দেখিনি। কিছু করার ক্ষমতা নেই। খালি হইহই। হাওয়ায় ভাসছে।

সব তো ফ্লপ শো ওদের। নিজের ওয়ার্ডে জেতার ক্ষমতা নেই, ঘুরে বেড়াচ্ছে।

সদ্যই অর্থদপ্তরের পূর্ণ দায়িত্ব পেয়েছেন চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। রাজ্যে এই প্রথম কোনও মহিলা অর্থমন্ত্রী পড়লেন বাজেট। শুক্রবার নির্ধারিত সময়ে বিধানসভায় পৌঁছন চন্দ্রিমা। বাজেট পেশের আগেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন তিনি। বলেন, আমাদের মুখ্যমন্ত্রী বরাবরই ইতিহাস তৈরি করেছেন। আমি কৃতজ্ঞ মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। তিনি যে আমাকে বাজেট পেশ করার এই সুযোগ দিয়েছেন, সেটা আমার কাছে এমন এক মুহূর্ত বলে বোঝাতে পারব না। আমি তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই।

এদিকে বিধায়ক সাসপেনশনের ঘটনার রেশ ধরে এদিনও অধিবেশনে অশান্তির আশঙ্কা করেছিল শাসকদল। তার মাঝেই নির্ধারিত সময়ে অর্থাৎ বেলা ২ টোয় চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য শুরু করেন বাজেট পেশ। ঠিক ১৪ মিনিটের মাথায় বিক্ষোভ শুরু করে বিজেপি। তা সত্ত্বেও গলা চড়িয়ে বাজেট পড়তে থাকেন অর্থমন্ত্রী। এদিকে সুর চড়াতে থাকে বিজেপিও। ওঠে স্লোগান। পালটা স্লোগান তোলে তৃণমূল। বিজেপিকে থামতে অনুরোধ করেন স্পিকার। সবমিলিয়ে তীব্র হট্টগোল শুরু হয় বিধানসভায়। এদিকে মাঝে মাঝে বাজেটের সমর্থন করে ট্রেজারি বেঞ্চ। বাজেট পড়া শেষ হওয়ার আগেই অধিবেশন ওয়াক আউট করে বিজেপি। বিরোধী শূন্য কক্ষে বাজেট পড়েন অর্থমন্ত্রী। মু্খ্যমন্ত্রীর কবিতার মাধ্যমে বাজেট শেষ করেন চন্দ্রিমা। এবার ২৮, ২৭৯ কোটি টাকা ঘাটতি বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী।

বাজেট পেশের পরই সরকারকে তুলোধোনা করেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। বাজেটে কোনও কিছুই নেই বলে দাবি করেন তিনি। বিধানসভা চত্বরে চলে স্লোগান। সব মিলিয়ে উত্তাল হয়ে ওঠে বিধানসভা।  

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version