অ্যাশ ওয়েডনেসডের আগের দিন যে মঙ্গলবার, সেটা ইতালীয় ভাষায় কার্নিভাল নামে পরিচিত। শব্দটি এসেছে লাতিন ভাষার ‘কার্নিস ফেভার’ শব্দ থেকে। ‘কার্নিস ফেভার’-এর আক্ষরিক অর্থ ‘মাংস মরিয়ে রাখা’ বা মাংস না খাওয়া। কার্নিভাল-এর বয়স হাজার বছর তো হবেই। ধারণা, কার্নিভাল উদযাপন করার বিষয়টি এসেছে সাতুরলানিয়ার প্যাগান উৎসব থেকে। প্রকৃতির আনুকূল্যে ফসলের চাষ এবং প্রচুর পরিমাণে ফসল উৎপাদনের জন্য প্রকৃতির দেবতাকে তুষ্ট করতেই এই প্যাগান উৎসবের আয়োজন করা হত। প্রথমদিকে ক্যাথলিক চার্চের তত্ত্বাবধানে এই উৎসবটির আয়োজন করা হত।
প্রাচীন রোমের লুপারকালিয়া ও বাকানালিয়া উৎসবের মতো এটিও বহুকালের পুরনো এক পাগান উৎসব। এপিফ্যানির দিন থেকে অর্থাৎ অ্যাশ ওয়েডনেসডের আগের দিন, মঙ্গলবার থেকে টানা ১৫ দিন আমোদে ডুবে থাকার উৎসব হল কার্নিভাল। রোমান, ক্যাথলিক দেশগুলিতে আজও সেই একইরকম জাঁকজমক আর হৈ-হুল্লোড়ের সঙ্গে এই উৎসব পালিত হয়। খাওয়াদাওয়া, পান, ভোজন ইত্যাদি আমোদ লেন্ট পর্বের সময় বারণ। লোকে তাই এই সময়ে শখ মেটানোর আতিশায্যে মেতে ওঠে। তবে বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই বার্ষিক কোনো উৎসবকে কেন্দ্র করে কার্নিভালের আয়োজন করে থাকে।
কার্নিভালের আয়োজনের মধ্যে আফ্রিকার মানুষের প্রভাব খুঁজে পাওয়া যায়। এমনিতেই আফ্রিকার মানুষদের জীবনযাত্রার সঙ্গে নানা উৎসব জড়িয়ে আছে। যে উৎসবগুলিতে তারা বৈচিত্র্যময় পোশাক, বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে নাচ-গান, খাওয়া-দাওয়া সমেত নানা আমোদ-ফুর্তিতে নিজেদের মাতিয়ে রাখে। প্রকৃতির নানা উপকরণ থেকে তৈরি মুখোশ, খড়, লতাপাতা, মাটি দিয়ে তৈরি ভাস্কর্য তাদের উৎসবের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।একসময় আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে কালো মানুষদের ক্রীতদাস হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পাঠানো হতো।
যে সময় ক্যারিবীয়ান দ্বীপপুঞ্জ, ব্রাজিল এবং আফ্রিকার বিভিন্ন জায়গায় পর্তুগিজ থেকে শুরু করে ইংরেজ, ডাচ, ফরাসিদের কলোনি গড়ে উঠতে থাকে। সেখানকার কলোনিতে শ্বেতাঙ্গ লোকজন যখন কার্নিভালের আয়োজন করত, তখন উৎসব নতুন পোশাকে সমবেত প্রার্থনা এবং খাওয়া-দাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। একসময় আফ্রিকার ক্রীতদাসরা এই উৎসবে যোগ দিতে থাকে। তখন মুক্তির স্বাদে তারা নিজেদের ঐতিহ্য অনুসারে, গান, নাচ আনন্দে নিজেদের মাতিয়ে রাখত। তাদের দেখে অন্যরাও উদ্বুদ্ধ হতে থাকে। পরবতীর্তে আফ্রিকান এই প্রাচীন ঐতিহ্যই কার্নিভালের প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে।
কার্নিভালের প্রধান আকর্ষণ রং-বেরঙের পোশাক আর বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। প্রাচীন রোমে বলি দেওয়ার সময় শোভাযাত্রা বের হত। সেই প্রাচীন প্রথারই এক অনুকরণ পরবর্তীতে বিভিন্ন দেশের কার্নিভালে দেখা যায়। কার্নিভালে রাস্তায় মুখোশ পরে সবাই নাচের আনন্দে মেতে ওঠে। প্রতিটি মানুষের মুখে থাকে অদ্ভুত সব মুখোশ। চাকার ওপর বসিয়ে, রাজপথ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সুবিশাল, সুসজ্জিত সব ট্যাবলো। উৎসবে একজনকে রানী ও একজনকে রাজা সাজানো হয়। শোভাযাত্রার লোকজন ফুটপাতে দাঁড়ানো দর্শকদেরও আমোদে টেনে নিতে চায়।
পথচারীদের দিকে তারা ফুল, মিষ্টি ইত্যাদি ছুঁড়ে দেয়। আগে ছাই, জঞ্জাল এসব ছোঁড়া হতো। পরে সেই প্রথাটা ক্রমশ বদলে যায়। জার্মানিতে মানুষেরা আবার বিভিন্ন পশুর মুখোশ পরে নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে। সেই মিছিলে হাতি আর ভালুক থাকে। তারা দর্শকদের কাছ থেকে পয়সা সংগ্রহ করে। ইংল্যান্ডে এই পর্বের জন্যই বিখ্যাত প্যান-কেক তৈরি হয়। ইংল্যান্ডের কার্নিভাল থেকেই সারা পৃথিবীতে একদিন প্যান-কেক ছড়িয়ে পড়েছিল।
কলকাতার দুর্গোৎসবকে ইনট্যানজিবল হেরিটেজের স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেসকো। তারপর থেকেই শুরু হয়েছে জাঁকজমকপূর্ণ পুজোর কার্নিভাল।২০১৬ সালে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে প্রথম কলকাতায় দুর্গাপুজো কার্নিভালের আয়োজন করা হয়। শহরের সেরা পুজোগুলি এই কার্নিভালে অংশ নেয়। যত বছর ঘুরেছে কার্নিভাল নিয়ে ক্রেজ ততই বেড়েছে।বিজয়া দশমীর পর একটি নির্দিষ্ট দিনে কার্নিভালের আয়োজন করা হয়। একটি বিশেষ শোভাযাত্রার মাধ্যমে রেড রোড দিয়ে প্রতিমাগুলি নিরঞ্জনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। এই কার্নিভালে উপস্থিত থাকেন দেশ বিদেশের বিশেষ অতিথিরা।
কিন্তু এবার কলকাতায় ছিল জোড়া কার্নিভাল। একটি পুজোর কার্নিভাল, রেড রোডে। অন্যটি ‘দ্রোহের কার্নিভাল’ রানি রাসমণি রোডে জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টর্দের প্রতিবাদ কর্মসূচি। কেবলমাত্র চিকিৎসকরাই নন, প্রচুর সাধারণ মানুষ এই কার্নিভালে যোগ দেন। অন্যদিকে রাজ্য সরকারের কার্নিভালে ঝলমলে মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাততালি দেন মুখ্যমন্ত্রী। কয়েকজন শিল্পী তথা রাজনীতিবিদ তাঁকে ঘিরে ছিলেন।