ছাপ্পান্ন দিন আগের কথা। আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের অ্যানাটমি ভবনের সামনে অতি বিষণ্ণ ও মনমরা মুখ নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ওঁরা। ওঁরা ওই হাসপাতালেরই জুনিয়ার ডাক্তার। গত রাতে হাসপাতালের ভিতর একটি বীভৎস খুন ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। যে মর্মান্তিক ঘটনার শিকার ওঁদেরই এক কর্তব্যরত সতীর্থ।  অ্যানাটমি ভবন লাগোয়া একটি গাছের তলায় দাঁড়ানো ওই জুনিয়ার ডাক্তারেরা একত্রিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন এর প্রতিবাদ করতে হবে। সঙ্গী হলেন ওই হাসপাতালের অন্যান্য চিকিৎসক-পড়ুয়ারা। একে একে ওদের প্রতিবাদে স্বর মেলালেন চিকিৎসক সমাজ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ। সেদিনই তারা স্থির করেছিলেন তাঁদের প্রতিবাদ আন্দোলনে রাজনীতির রং মিশতে দেবেন না। শুরু হল বিচারের দাবিতে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন। যে প্রতিবাদ বিক্ষোভের আন্দোলনকারীরা ১৪ অগস্ট রাতে তাণ্ডবের পরেও ভয় পাননি, শাসক দলের নেতা মন্ত্রীদের শাসানি, গর্জানি, কটুক্তিতে বিচলিত হননি বরং রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সামগ্রিক পরিবর্তনের দাবিতে আরও বেশি প্রতিঙ্গাবদ্ধ হয়েছেন, হুমকি বা থ্রেট কালচার সহ বিভিন্ন অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে হাত-পা না ছুঁড়ে, চিৎকার না করে নিজেদের মতো করে হুমকি প্রথার বিরুদ্ধাচারণ-সহ বেশ কিছু দাবি ছিনিয়ে আনতে পেরেছেন তাঁরা। 

প্রসঙ্গত, আর জি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যার বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি শুরু করেছিলেন জুনিয়র চিকিৎসকরা। লাগাতার ৪২ দিন কর্মবিরতি চলার পর রাজ্য সরকারের আশ্বাসের ভিত্তিতে তাঁরা কাজে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু ২৭ সেপ্টেম্বর সাগর দত্ত হাসপাতালে এক রোগীর মৃত্যু ঘিরে রোগীর বাড়ির লোকজন বা বহিরাগতরা মহিলা বিভাগে ঢুকে হামলা করায় পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে যায়। ফের পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতির পথে নামেন জুনিয়র ডাক্তাররা। উল্লেখ্য, প্রথম দফার কর্মবিরতিতে সরকারি হাসপাতালের পরিষেবা যাতে বিপর্যস্ত হয়ে না পড়ে তার জন্যে সিনিয়র চিকিৎসকরা বাড়তি চাপ সামলানোর চেষ্টা করেছেন। জুনিয়র ডাক্তারদের অনুপস্থিতি সেটা পুরোটা পূরণ করতে না পারলেও কাজ হয়। ২১ সেপ্টেম্বর কাজে যোগ দিলেও দ্বিতীয় দফায় গত সোমবার থেকে জুনিয়র ডাক্তারেরা ফের পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতির ডাক দেয়। সেদিন সুপ্রিম কোর্টে আর জি কর মামলার শুনানি ছিল। উল্লেখ্য, ২১ সেপ্টেম্বর থেকে কর্মবিরতির অংশ হিসেবে জুনিয়র ডাক্তাররা আংশিক ভাবে কাজে ফিরলেও, ১ অক্টোবর থেকে সাগর দত্ত হাসপাতালের ঘটনা নিয়ে পূর্ণ কর্মবিরতি শুরু করেন তারা।

সিনিয়র ডাক্তাররা আন্দোলনের সমর্থনে থাকলেও জুনিয়র ডাক্তারদের পূর্ণ কর্মবিরতির সিদ্ধান্ত নিয়ে এখন পরামর্শ, আন্দোলন এবং প্রতিবাদ চালিয়ে যাওয়া হলেও, রোগীদের সুরক্ষা এবং পরিষেবার জন্য কর্মবিরতির পরিবর্তে অন্য পথে আন্দোলন। বৃহস্পতিবার আরজি কর হাসপাতালের অডিটোরিয়ামে জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে বৈঠকে এই পরামর্শ দিয়েছেন সিনিয়রদের একাংশ। তাঁরা কর্মবিরতি তুলে নিয়ে আন্দোলনের অন্য পথ খুঁজতে জুনিয়রদের অনুরোধ জানাচ্ছেন। তবে কর্মবিরতি চালিয়ে যাবেন কি না সেটা সম্পূর্ণভাবে জুনিয়র ডাক্তারদের উপর ছেড়ে দিয়েছেন। সিনিয়র ডাক্তারদের মতে, বর্তমান সময়ে বন্যা পরিস্থিতি এবং পুজোর মরসুম মাথায় রেখে আন্দোলন চালানোর অন্য পথ খুঁজে বের করা জরুরি। সিনিয়র ডাক্তারদের স্পষ্ট বক্তব্য, তারা জুনিয়রদের বিচারের দাবিকে সমর্থন করছেন এবং তাদের পাশেই আছেন। তবে রোগীদের স্বার্থে কিছুটা হলেও কর্মবিরতি শিথিল করার আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রসঙ্গত, সুপ্রিম কোর্টের শুনানির পর জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে আট ঘণ্টার জিবি বৈঠকে কর্মবিরতির বিকল্প নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। অনেকেই পূর্ণ কর্মবিরতির পরিবর্তে অন্য কোনো আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ধর্মতলায় ৩০ সেপ্টেম্বরের সভামঞ্চ থেকে ‘জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অব ডক্টর্স’ এর প্রতিনিধি পুণ্যব্রত গুণও কর্মসূচি নির্ধারণের সময় মানুষের সুরক্ষার কথা বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দেন।

এই আন্দোলনের অন্যতম মুখ দেবাশিস হালদার বলেন, “আমরা আন্দোলন থেকে সরব না। আরও তীব্র হবে প্রতিবাদ। প্রয়োজনে দিল্লি যাব। যদি আমরা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করি, সেটা কারো চাপে নয়, জনতার স্বার্থে করব। এতে আন্দোলনের ঝাঁজ কমবে না।” জুনিয়র চিকিৎসকদের একাংশের মতে, কাজ চালিয়ে আন্দোলন তীব্র করে তোলা সম্ভব। একদিকে সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে বিচার প্রক্রিয়া চলছে। অন্যদিকে পরিষেবায় সামিল হলে জনতার সহানুভূতি তাদের সঙ্গে থাকবে। কাজে ফেরা নিয়েও জুনিয়র চিকিৎসকদের নানা মত সামনে এসেছে। তবে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও ঘোষণা করা হয়নি। একটি সূত্রের খবর, এসএসকেএম বা কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ধর্মতলা মেট্রো চ্যানেল অথবা গান্ধী মূর্তি পর্যন্ত একটি মিছিল করতে পারেন জুনিয়র ডাক্তাররা। কিছু জুনিয়র ডাক্তার জিবি বৈঠকে অনশনের পরামর্শ দিয়েছিলেন বলেও সূত্রের খবর। তবে জুনিয়র ডাক্তারদের কাজে ফেরার সম্ভাবনা রয়েছে, এমনটাই দাবি করছে অপর একটি সূত্র। শুক্রবার তাঁরা সংবাদ মাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে আন্দোলনের পরবর্তী রূপরেখা স্পষ্ট করতে পারে বলে জানা যাচ্ছে।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version