সাগরের বুকে ভেসে থাকা ছোট্ট একটি দ্বীপ। চারপাশে সারি সারি পাইন আর ছড়ানো ছেটানো ছোটবড় টিলা। ছবির মতো সুন্দর এই দ্বীপটির নাম বেস্টয়। দ্বীপজুড়ে রয়েছে একটি জেলখানা। আয়তন প্রায় এক বর্গমাইল। জেলটিতে রয়েছে বেশ কয়েক ধরনের বাড়ি। চেরি ফলের মতো লাল রঙের এক কামড়ার কটেজ, সাদা রঙের কয়েকটি বাড়ি, অনেক কামড়া নিয়ে বিশাল বাড়ি 'বিগ হাউস'; অনেকটা কলেজ হোস্টেলের মতো। কয়েদিরা ইচ্ছামতো থাকতে পারে যেকোনো কামড়ায়। ব্যবস্থা সে রকমই।

আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো একেবারেই নয়, বেস্টয় জেলে দাগি আসামিরা থাকে রাজার হালে। তবে নিয়ম হল প্রত্যেকদিন ঠিক সকাল সাড়ে ৮টায় রিপোর্ট করতে হয়। তার আগেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়তে হয়। প্রাতঃকৃত্য সেরে হাজিরা দেওয়ার পরই শুরু করতে হয় যার যার কাজ- কেউ বাগানে জল দেয়, কেউ করে আগাছা পরিস্কার, কেউ যায় রান্নার কাঠ কাটতে, নানা ধরণের কাজ চলে কিন্তু কাজ তদারকির জন্য কেউ থাকে না।

সাড়ে ৩টে বাজলেই কাজ শেষ। তখন ফের হাজিরা। তখন নাম ডেকে কয়েদিদের হাতে তুলে দেওয়া হয় দৈনিক মজুরি। যা প্রায় ১০ ডলার। এছাড়া মাস শেষে দেওয়া হয় ১২৫ ডলার করে বকশিশ। রোজগারের পুরোটাই কয়েদিরা ইচ্ছামতো খরচ করতে পারে। স্থানীয় দোকান থেকে এটা-সেটা কেনাকাটা, ডেকে খাওয়াতে পারে বন্ধুবান্ধবকে। প্রতিদিনের কাজের শেষে কেউ ছিপ হাতে বসে মাছ ধরতে, কেউ লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পড়ে, কেউ শেখে কম্পিউটার।

জেল কয়েদি হলেও নির্দিষ্ট পোশাক নেই। জিনস, টি-শার্ট যা খুশি কিনে এনে পড়তে পারে। তবে জেলের কর্মীদের পরতে হয় নির্দিষ্ট পোশাক। জেলে সাজানো-গোছানো একটাই রান্নাঘর। জেলের বাগানের সবজি দিয়ে প্রতিদিন বেশ কয়েকটি পদ রান্না হয়। কোনো দিন মাছের চপের সঙ্গে পরিবেশন করা হয় সুস্বাদু সস, কোনো দিন থাকে বড় বড় সামুদ্রিক চিংড়ি ভাজা। আবার কখনো খেতে দেওয়া হয় স্যামন মাছ, মুরগির বিশেষ পদ।

এই জেলে না আছে গারদ, না আছে পুলিশের টহলদারি কিম্বা ভয়ংকর কুকুর। এখানে কোনো তারকাঁটা দেওয়া উঁচু দেওয়ালও যেমন নেই, তেমই কোনো ঘুপচির মতো দল।এ পর্যন্ত যা জানাবোঝা গেল তাতে এই বেস্টয় প্রিজনকে আজব জেলখানা বলাই যায়। জেলখানা হলেও এখানকার হালচাল দেখে প্রায় সবাই রিসোর্ট বলে মনে করে।তবে জানিয়ে ছিঁচকে চোর বা ওই ধরনের অপরাধ যারা করে তাদের কিন্তু সামান্য শাস্তি দেওয়ার জন্য এই দ্বীপে এনে নবাবি হালে রাখা হয় না। খুন, ডাকাতির মতো গুরুতর অপরাধ করা আসামিরাই এখানে ঠাই পায়। বড়সড় অপরাধ করা অপরাধীদের সাগরের মাঝে জেগে ওঠা মনোরম এক দ্বীপে এনে রং-বেরঙের কটেজে থাকতে দেওয়া, আয়েশি জীবন যাপন করতে দেওয়া- এটা একেবারেই যুক্তিযুক্ত মনে করেন না বেশিরভাগ মানুষ।

যিনি সাধারণ জেলখানার ধারণা পুরোপুরি পাল্টে দিতে এমন এক জেলখানা বানিয়েছিলেন, তাঁরও কিছু যুক্তি রয়েছে এর পেছনে। প্রাক্তন গভর্নর নিলসেন মনে করেছিলেন, যদি জেলখানায় এনে কোনও আসামির আচরণে পরিবর্তনই না আনা যায়, তাহলে আর তাকে জেলখানায় আটকে রেখে লাভ কী? তাই এমন একটা জেলখানা যেখানে কয়েদিদের এমন জীবনযাপনে অভ্যস্ত করা হয়, যাতে তাদের শাস্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তারা আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো হয়ে ওঠে, ভদ্র ও সভ্য জীবন যাপন করতে পারে।

বেস্টয় প্রিজন নির্মাতাদের ভাবনা যে কাজে আসেনি একথা বলা যাবে না।সরকারি অনুমোদন নিয়ে জেলখানাটি বানিয়েছেন আর্ন কার্নভিক নিলসেন। তিনি পেশায় মনোচিকিৎসক। কয়েদি হিসেবে এই জেলে কারা থাকবে, সেটা ঠিক করেন তিনি। সরকারি জেলখানায় চিঠি দিয়ে কিছু কয়েদিদের এখানে পাঠানোর অনুরোধ জানান। সরকার কখনো সে অনুরোধ রাখে, কখনো রাখে না। তবেএ পর্যন্ত দেখা গিয়েছে, এখান থেকে মুক্তি পাওয়া আসামিদের মধ্যে বেশির ভাগই পরবর্তী জীবনে আর কোনও অপরাধ করেনি। শতাংশের হিসাবে প্রায় ৮৪ শতাংশ খারাপ কাজ করা ছেড়ে দেয়। মাত্র ১৬ শতাংশ ফের কোনও অপরাধমূলক কাজে জড়িয়েছে। সেদিক থেকে বলতে গেলে ১৯৮২ সালে গড়ে ওঠা এক বর্গমাইলের বেস্টয় প্রিজন কারাগারের সংজ্ঞাই যেন পাল্টে দিয়েছে।

নতুন অপরাধীরা এই জেলে এলে তার সঙ্গে কথা কুশল বিনিময় করে নিলসেন একটা কথাই বলেন- যদি পালাতে চাও, যেতে পারো, তবে সাগর পেরোনোর পর দয়া করে একটা ফোন দিয়ো আমাদের। যেন বুঝতে পারি, তুমি ঠিক আছ। তাহলে শুধু শুধু কোস্টগার্ড পাঠিয়ে তোমাকে খুঁজে বেড়াতে হবে না।

Share.

2 Comments

  1. কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলতে পারি কিন্তু জায়গা কি মিলবে?

  2. sarbani chakrabarty on

    বিলাসবহুল জেলখানার কথা শুনেছি কিন্তু এটি তো একেবারে অভিনব।

Leave A Reply

Exit mobile version