আটপেয়ে ওই জীবটিকে দেখলে প্রায় সবাই ঘেন্না পায়। অথচ সেই জীবটির নামের পাশেই ‘ম্যান’ বা মানব কথাটি জুড়ে একটি চরিত্র সৃষ্টি হল। দেখা গেল সে কিন্তু খুব দ্রুত শৈশব-কৈশোরের অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে। তাদের মনে অজান্তেই পরম আত্মীয় হয়ে উঠছে। এমনকি ঘুমের মধ্যেও সে তাদেরকে হাত ধরে অজানা দুনিয়ায় ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে নিত্যনতুন অভিযানে। কে সে? একটি সরল ছেলে, যার চোয়াল শক্ত করা অনমনীয় জেদ আর লড়াইয়ের কাছে হার মানে বিপদ, মুশকিল আসান হয়, অন্ধকারে আশার আলো ফোটে। এই অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী ছেলেটি সুপারহিরো। তবে তাকে কেবলমাত্র পেশিশক্তির অধিকারী বলা যায় না, তারিফ করতে হয় তার বুদ্ধিমত্তাকেও।

অথচ স্ট্যান লি-র এই মাকড়সা-মানব বা ‘স্পাইডারম্যান’-এর ভাবনাটির কথা তাঁর প্রকাশক শোনামাত্রই বাতিল করে দিয়েছিলেন। প্রকাশকের তরফের যুক্তি মোটেও ফেলে দেওয়ার মতো ছিল না। কে কিনবে এই বই? যেখানে সুপারহিরোরা বাজার দাপাচ্ছে, সেখানে এই পুচকে ছেলে কি করবে? মাকড়শার মতো জাল বুনে দেওয়াল বেয়ে উঠলেই হবে, হ্যা সেও শত্রুদের ঘায়েল করতে উঁচু উঁচু বাড়ি থেকে লাফ মারছে কিন্তু সে অতিমানব নয়, অসীম ক্ষমতাধরও নয়, স্পাইডারম্যান! ওর অনেক আগে থেকে যারা রাজত্ব কায়েম করেছে তাদের কীর্তিকলাপে মুগ্ধ হয়ে ভয়ভক্তিতে উদ্বেল হয়ে ভক্তরা মোহাবিষ্ট হয়ে আছে। আর এই একরত্তি ছোকরা তো আর পাঁচজনের মতোই, তার কাণ্ডকারখানা কি আর শিশু-কিশোর মনে নাড়া দিতে পারবে?

কিন্তু স্ট্যান লি প্রকাশকের কোনও কথাই কানে তুললেন না। একরোখা সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত স্পাইডারম্যান তৈরি করেই ছাড়লেন। নিউ ইয়র্ক সিটির বাসিন্দা আঙ্কেল বেন ও আন্ট মে-র পরিবারে বেড়ে ওঠা স্কুলছাত্র পিটার পার্কারকে স্কুলের এক বিজ্ঞান প্রদর্শনীতে তেজস্ক্রিয় মাকড়শা কামড়ালে সে মাকড়শার মতো ক্ষিপ্রতা আর ক্ষমতা লাভ করতে থাকে। স্পাইডার সেন্স এর মাধ্যমে সে আগাম যে কোনও আক্রমণের আভাষ পায়। এরপরই সে তার বিজ্ঞান দক্ষতায় বানিয়ে নেয় একটি ছোট যন্ত্র যা দিয়ে আঠালো জাল বুনে ছুড়ে দেওয়া যায়। এছাড়া সে অসাধারণ সব ক্ষমতার অধিকারী- ক্ষিপ্রতার সঙ্গে দেওয়াল বেয়ে ওঠানামা, খালি হাতে লড়াই। প্রখর বুদ্ধিমাত্রা, আশ্চর্য পর্যবেক্ষণ শক্তিধর স্পাইডারম্যানের পোষাকটিও নির্দিষ্ট।

একদিন স্পাইডারম্যান একটি চোরকে না ধরে পালানোর সুযোগ করে দেয়। পরবর্তীতে সে জানতে পারে ওই চোর তার কাকা বেনকে হত্যা করেছে। স্পাইডারম্যান সেই খুনীকে খুজেঁ বের করে প্রতিশোধ নেয়। কিন্তু এরপর থেকে স্পাইডারম্যান নিজের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে জনকল্যান মূলক কাজ করতে থাকে। নিউ ইয়র্ক সিটিকে নানা বিপদ থেকে বাঁচাতে থাকে। দুই মলাটে ধরা সেই কাহিনি পড়ে আলোকিত,আমোদিত হল শৈশব। তারপর একদিন স্পাইডারম্যান শৈশবের কমিকসের গন্ডী পেরিয়ে উঠে এল সিনেমার পর্দায়। এই মাকড়শা মানবটির জন্ম হয়েছিল আজ থেকে ষাট বছর আগে। ১৯৬২ সালের অগাস্ট মাসে, ‘অ্যামেইজিং ফ্যান্টাসি’র ১৫ নম্বর সংখ্যায়। যাকে কমিকে স্পাইডি, ওয়েব-স্লিঙ্গার, ওয়াল-ক্রলার বা ওয়েব-হেড নামেও ডাকা হয়।

স্ট্যান লি স্পাইডারম্যান ছাড়াও আরও বহু চরিত্রের স্রষ্টা। তাঁর সব চরিত্ররাই সুপারহিরো অথচ কেউই দোষত্রুটির ঊর্ধ্বে থাকা অতিকায় অতিমানব নয়। বলা ভাল লি-র সুপারহিরোদের আড়ালে রয়ে গিয়েছে রক্তমাংস বিশিষ্ট মানুষ। তাই তাঁরা টাকার চিন্তায় ব্যাকুল হয়, আয়রনম্যান অ্যালকোহলে ডুবে থাকে, তেমনি স্পাইডারম্যানও চাকরি নিয়ে, গার্লফ্রেন্ড নিয়ে সমস্যায় জেরবার হয়। শুধু কি তাই স্পাইডারম্যান প্রেমে জোর ধাক্কা খেয়ে ব্যর্থ হয়, ব্যর্থ প্রেমিকের মতো সেও ভারাক্রান্ত মনে নুয়ে পড়ে, এক সময় তার প্রেমিকা মারাও যায় শত্রু হবগবলিনের হাতে। স্পাইডারম্যান সুপারহিরো হয়েও নিজের প্রেমিকাকে বাঁচাতে পারে না। কারণ, সে যে নিজেই রক্তমাংসের মানুষ, ঈশ্বরও নয়। তাই তার জীবনে দুঃখ, হতাশা, ব্যর্থতা সবই আছে, আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের যেমন থাকে।

এই জন্যই কমিকস দুনিয়ায় স্পাইডারম্যানের এত জনপ্রিয়তা। যে রমরমায় স্পাইডারম্যান বিগত ছয় দশক ধরে পাঠক পরবর্তীতে দর্শকদের চোখের মণি হয়ে থেকেছে। এক সময় স্পাইডারম্যান ছিল কেবলমাত্র আমেরিকার সুপারহিরো, এখন আন্তর্জাতিক দুনিয়ার। আসলে সবাই এই অনাথ কিশোরটির সঙ্গে এক আত্মিক যোগ খুঁজে পায়। মনে হয় স্ট্যান লিও চেয়েছিলেন সেই সংযোগকেই যোগসূত্র করতে। আজ পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সফল সুপারহিরো স্পাইডারম্যান। স্পাইডারম্যান শুধুমাত্র মারভেল কমিকসের বেস্ট সেলিং কমিকস নয় ফ্ল্যাগশিপ চরিত্র এবং কোম্পানির মাস্কট। মাত্র বারো সেন্টের সেই কমিকস যে বদলে দিয়েছিল পুরো কমিকস দুনিয়াটাকে।
Share.

2 Comments

  1. shrimati nandi mazumdar on

    মাকড়শার আড়ালে যেমন রক্তমাংসের মানুষ তেমনি স্ট্যান লি-র স্পাইডারম্যানের আড়ালেও যে এত ঘটনা জানা ছিল না। সমৃদ্ধ হলাম।

  2. dipankar dasgupta on

    ঠিকই বলেছেন; মাকড়সা-মানুষ সুপারম্যান হলেও তার আর পাঁচজনের মতো সমস্যা আছে, দুঃখ আছে, ব্যর্থতা আছে আর সেই জন্যেই তাঁকে খুব কাছের মনে হয়,
    চেনা-জানা মনে হয়, তাঁর সঙ্গে একটা যোগাযোগও তৈরি হয়।

Leave A Reply

Exit mobile version