তাঁর নাম উচ্চারিত হলেই যে দৃশ্যটি প্রথমে চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তা হল একটি লোক স্নানঘর থেকে নগ্ন অবস্থায় বেরিয়ে গ্রিসের রাস্তা দিয়ে “ইউরেকা, ইউরেকা” চিৎকার করতে করতে দৌড়াচ্ছেন। এর ঠিক আগেই তিনি চৌবাচ্চার জলে স্নান করার সময় জল উপচে পড়তে দেখেন। এরপরই তিনি  একটি জলভর্তি চৌবাচ্চায় এক কেজি সোনা ডুবিয়ে কি পরিমাণ জল উপচে পড়ে তার সঙ্গে একই পরিমাণ রূপো ডুবিয়ে কি পরিমাণ জল উপচে পড়ে তার তুলনা করেন। লিভারের নীতি ও তরলে নিমজ্জিত বস্তুর ওপর ক্রিয়াশীল ঊর্ধ্বমুখী বলের সূত্র আবিষ্কার করে ধাতুর ভেজাল নির্ণয় করতে সমর্থ হন। ইনি গণিতবিদ ও বিজ্ঞানী আর্কিমিডিস। যিনি অসম্ভব প্রতিভাবান এবং সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে থাকা একটি মানুষ, জন্মেছিলেন খ্রিষ্টপূর্ব ২৮৭ সালে, ভূমধ্যসাগরের সিসিলি দ্বীপে। ওই সময় সেই দ্বীপের নামকরা শহর ছিল সিরাকিউজ এবং জায়গাটিতে ছিল গ্রিকদের বসতি।

পদার্থবিদ্যায় তার উলেস্নখযোগ্য অবদানের মধ্যে রয়েছে- হাইড্রোস্ট্যাটিক নীতি, লিভার এবং পুলির নীতি আবিষ্কার। যুদ্ধকালীন আক্রমণের জন্য সিজ ইঞ্জিন ইত্যাদি মৌলিক যন্ত্রপাতি ডিজাইনের জন্যও তিনি বিখ্যাত। তিনি গোলকের আয়তন এবং পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল নির্ণয়ের সূত্র আবিষ্কার করেন। তাঁর আবিস্কারের মধ্যে রয়েছে সূচক ব্যবহার করে বড় সংখ্যা লেখার পদ্ধতি, সূচকীয় সংখ্যা গুণ করার ক্ষেত্রে সূচকদ্বয়কে যোগ করার প্রক্রিয়া, গ্রিক লেখক অথেনিয়াস অভ নক্রেটিসের বর্ণনা অনুযায়ী, রাজা দ্বিতীয় হিয়েরো আর্কিমিডিসকে একটি বিশাল জাহাজ তৈরি করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সিরাকিউসা নামের এই জাহাজটিকে প্রয়োজনানুযায়ী প্রমোদতরী, রসদ-সরবরাহকারী এবং রণতরী হিসেবে ব্যবহার করা যেত। বলা হয়ে থাকে যে, ক্ল্যাসিকাল যুগে নির্মাণ করা সব জাহাজের মধ্যে সিরাকিউজ ছিল সব থেকে বড়। বিদু্যৎ ছাড়া জল এবং কয়লা, শস্যদানা জাতীয় ক্ষুদ্রাকৃতির পদার্থ উত্তোলনের জন্য আর্কিমিডিস স্ক্রু আবিস্কার করেছিলেন যাকে বর্তমানে ‘আর্কিমিডিসের স্ক্রু’ বলা হয়।

কোন কোন চশমার কাচ এমন হয় যে, তাতে অনেকটা সূর্যের আলো ধরা যায়। সেইরকম কাচ বেশ বড় করে বানালে, তার মধ্যে রোদ ধরে আগুন জ্বালানো যায়। সরার মতো গর্তওয়ালা আয়না দিয়েও এই কাজটি করা যায়। আর্কিমিডিস এইরকম আয়নাও বানিয়েছিলেন। শোনা যায়, রোমের যুদ্ধ জাহাজ যখন সাইরাকিউস আক্রমণ করতে আসে, তখন তিনি এইরকম আয়না দিয়ে কড়া রোদ ফেলে, তাতে আগুন ধরিয়ে দেন। কেবল তাই নয়, রোমীয় সেনাপতি মার্সেলাস যখন সৈন্য-সামন্ত নিয়ে সাইরাকিউস আক্রমণ করতে আসেন, তখন আর্কিমিডিস নগররক্ষার জন্য  অদ্ভুত নূতন নূতন যুদ্ধযন্ত্রের আয়োজন করেছিলেন। সেই সব যন্ত্রের কথা জানতে পেরে রোমীয় সৈন্যরা বহুদিন পর্যন্ত নগরের কাছে ঘেঁষতে সাহস পায়নি। তার পরেও বহু যুগ ধরে, দেশে দেশে আর্কিমিডিসের অদ্ভুত কীর্তির কথা লোকের মুখে মুখে শোনা যেত।

রোমীয় সৈন্যরা যেসব যুদ্ধেযন্ত্রের বর্ণনা দিয়েছে, তা জানলে বেশ বোঝা যায়, সেগুলি তাদের মনে কিরকম ভয়ের সঞ্চার করেছিল। বড় বড় থামের মতো চুড়া হঠাৎ দেয়ালের ওপর মাথা তুলে, হুড়হুড় করে শত্রুর ওপর রাশি রাশি পাথর ছুঁড়ে মারে, আবার পর মুহূর্তেই দেয়ালের পিছনে ডুব দেয়। বড় বড় কলের ধাক্কায় কড়ি বড়গা ছুটে গিয়ে শত্রুর জাহাজের ওপর পড়ে, দূর থেকে বিরাট আকারের সাঁড়াশি চালিয়ে শত্রুর জাহাজ উপড়ে আনে। এই সব দেখে শত্রুরা রোমের সৈন্য আর রোমের জাহাজ নগর ছেড়ে দূরে হটে যায়। এই জন্যেই মার্সেলাস বলেছিলেন, “যুদ্ধ করে সাইরাকিউস দখল করা কারও সাধ্য নয়। তোমরা পথ ঘাট আটকে এখানেই বসে থাকো। নগরের খাদ্য যখন ফুরিয়ে যাবে, তখন আপনা থেকেই ওরা হার মানবে।” প্রায় তিন বছর বিনা যুদ্ধে রোমীয়েরা সাইরাকিউসের চারিদিক ঘিরে রাখে। তারপর নগরের লোকদের যখন না খেয়ে মারা যাবার মতো অবস্থা, তখন সাইরাকিউস দখল করা সহজ হয়ে যায়।  এর পর মার্সেলাস হুকুম দেন, “যাও, নগর লুট করে আনো, কিন্তু খবরদার, আর্কিমিডিসের যেন কোনো ক্ষতি না হয়।”

আর্কিমিডিস তখন হিসাব করছিলেন, নগরের কোথায় কি হচ্ছে, তাঁর হুঁশও নেই। কতগুলো অঙ্ক ও রেখার চিন্তায় তিনি ডুবে ছিলেন। রোমীয় সৈন্যেরা সেই ৭৫ বৎসরের বৃদ্ধকে আর্কিমিডিস বলে চিনতে পারেনি। তারা ঘরে ঢুকে তাঁর পরিচয় জিজ্ঞাসা করে। কিন্তু তিনি তাঁহার চিন্তার মধ্যে এমনই মগ্ন ছিলেন যে, সে কথা তাঁর কানেই গেল না। তিনি একবার খালি হাত তুলে বলেন, “হিসাবে ব্যাঘাত দিও না।”  সৈনিক তৎক্ষণাৎ তলোয়ারের আঘাতে তাঁহার মাথা কেটে ফেলে।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version