নামেই ‘পূর্বোদয় পরিকল্পনা’ কিন্তু কাজে বিহার আর অন্ধ্রের জন্য ঢালাও বরাদ্দ। মঙ্গলবার অষ্টাদশ লোকসভার প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাজেটে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামণ পূর্ব ভারতের জন্য পূর্বোদয় পরিকল্পনা ঘোষণা করে সংসদে বলেন, বিহার, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা এবং অন্ধ্রপ্রদেশের সর্বাঙ্গীণ উন্নয়নের জন্য নরেন্দ্র মোদি জাতীয় প্রবৃদ্ধির জন্য পূর্ব ভারতের কেন্দ্রীভূত উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছেন। এটি মিশন পূর্বোদয়-এর সারমর্ম। মিশন পূর্বোদয়কে পেট্রোলিয়াম এবং ইস্পাত উভয় ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। যা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান আগেই বলেছিলেন।
তবে এই বাজেটকে কোথাও গিয়ে ‘শরিকের ভরাসায়’ থাকা সরকারের জোট শরিকদের উপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। কারণ, বাজেটে পরপর ঘোষণা করা হল বিহার-অন্ধ্রপ্রদেশের জন্য। বিহারে তৈরি হবে বিমানবন্দর, বন্যা নিয়ন্ত্রণেও বিশেষ প্যাকেজ রাজ্যকে। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে গড়ে তোলা হবে আন্তর্জাতিক পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে, বন্যায় গৃহহীণদের জন্য ১১ হাজার ৫০০ কোটি বরাদ্দ করা হয়েছে। অন্ধ্রপ্রদেশের সড়ক পরিবহন পরিকাঠামো উন্নয়ন, জল, বিদ্যুৎ, শিল্পের জন্য বিশেষ প্যাকেজ দেওয়া হবে। চলতি অর্থ বর্ষেই অন্ধ্রপ্রদেশকে অতিরিক্ত ১৫ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হবে। ওই টাকা দেওয়ার মূল কারণ অন্ধ্রপ্রদেশকে রাজ্যের রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলা। লোকসভা নির্বাচনে ধাক্কার পর কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকার এখন পরনির্ভর। ফলে শরিকি বাধ্যতা ছিলই। বিজেপির দুই শরিক চন্দ্রবাবু নায়ডু এবং নীতীশ কুমারের মূল দাবিই ছিল অন্ধ্র এবং বিহারের জন্য বিশেষ প্যাকেজ। সেকারণে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভাতেও বিশেষ দাবিদাওয়া জানাননি শরিকরা। সেটা একপ্রকার বাধ্য হয়েই মেনে নিলেন নির্মলা। অন্যদিকে বাংলার সরকারের সঙ্গে কেন্দ্রের ‘বিবাদ’ সুবিদিত। সেক্ষেত্রে বাংলার জন্য বাড়তি বরাদ্দের কোনও বাধ্যতাও ছিল না কেন্দ্রের।
বাজেটে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, অন্ধ্রের নতুন রাজধানী অমরাবতীর পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য বাড়তি ১৫ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ দেওয়া হবে। শুধু তাই নয়, আগামী বছরগুলিতে এই ধরনের আরও একাধিক আর্থিক প্যাকেজ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন নির্মলা। অন্ধ্রের গ্রামোন্নয়নে ২.৬৬ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। বিহারের ক্ষেত্রে নির্মলা আরও উদারহস্ত। বিহারের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা মসৃণ করতে মোট ২৬ হাজার কোটি বরাদ্দ করা হয়েছে। এর পাশাপাশি গয়ার বিষ্ণুপদ মন্দির করিডোর তৈরি হবে কাশী বিশ্বনাথ করিডোরের ধাঁচে। বুদ্ধগয়ার উন্নয়নে বাড়তি বরাদ্দ করা হবে। নালন্দাকে পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে তুলে ধরার জন্য প্যাকেজ দেবে মোদি সরকার। মজার কথা হল, শরিকদের দখলে থাকা দুই রাজ্যের জন্য নির্মলা যখন এত বড় বড় সব প্রকল্পের নাম ঘোষণা করছেন, তখনও বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্পে বাংলার লক্ষাধিক কোটি টাকা কেন্দ্রের কাছে বকেয়া পড়ে রয়েছে বলে দাবি করছে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। এবারের বাজেটে বন্যা কবলিত একাধিক রাজ্যের জন্য প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। শুধু বিহারের জন্য বন্যা নিয়ন্ত্রণে বরাদ্দ করা হয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। আলাদা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে উত্তরাখণ্ড, হিমাচলপ্রদেশ, অসমের জন্যও। অথচ ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে টু শব্দটি শোনা গেল না বাজেটে।
চলতি অর্থবর্ষে সম্ভাব্য রাজকোষ ঘাটতি হতে পারে ৪.৯ শতাংশ। রাজকোষ ঘাটতি ক্রমশ কমানোর কথা জানান নির্মলা সীতারামন। তবে এই বাজেট নিয়ে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীকে সরাসরি আক্রমণ করেছেন অখিলেশ যাদব। সমাজবাদী পার্টির সুপ্রিমোর বক্তব্য, ‘উত্তরপ্রদেশের দিকে তাকালে ওখানের কি হাল আমরা দেখতে পাই! আর এখানে জোর গলায় বড় বড় কথা বলা হয়েছে। উত্তরপ্রদেশে যে প্রকল্পগুলি কেন্দ্রের চলছে তার একটাও সময়মতো শেষ হয়নি। সরকার বাঁচানো ভাল বিষয়। বিহার, অন্ধ্রপ্রদেশকে বিশেষ প্যাকেজ দেওয়া হয়েছে। উত্তরপ্রদেশ থেকে তো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। ওখানকার কৃষকদের জন্য কোনও বড় সিদ্ধান্ত আছে। বেকারত্ব কমাবে কেমন করে! এই অর্ধেক–অস্থায়ী চাকরি দিয়ে।’
এছাড়া দেশের চার শ্রেণীকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। গরিব, মহিলা, কৃষক এবং যুবক। দেশের ক্ষুদ্রশিল্প এবং মধ্যবিত্তের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব বাজেটে ঘোষণা করা হয়। কর্মসংস্থান ও দক্ষতায় বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে। বিকশিত ভারতের জন্য় রোডম্যাপ ঘোষণা করেন অর্থমন্ত্রী। দেশের অর্থনীতিতে বিকাশের হার ঊর্ধ্বমুখী করা হবে। আর কৃষিক্ষেত্রে সংস্কার ও গবেষণায় বিশেষ জোর দেওয়া হবে। অর্থমন্ত্রীর কথায়, ‘এই প্রস্তাবে সরকার ৯টি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েছে। সেগুলি হল—কৃষি উৎপাদন ও কৃষিতে স্থিতিশীলতা, কর্মসংস্থান ও দক্ষতার উন্নয়ন বৃদ্ধি, মানবসম্পদ বৃদ্ধি ও সামাজিক ন্যায়বিচার, কলকারখানা ও পরিষেবা বৃদ্ধি, চাকরির সুযোগ তৈরি, নগরোন্নয়ন, বিদ্যুৎ, পরিকাঠামো, গবেষণা ও আগামী প্রজন্মের জন্য সংস্কার’।