বছরের শুরুতেই খবরের শিরোনামে উঠে এসেছিল উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালি। শুরু হয়েছিল চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি, তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহানকে গ্রেফতার করতে গিয়ে উন্মত্ত জনতার হাতে প্রহৃত হয়েছিলেন ইডির আধিকারিকরা। প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ে পালাতে দেখা গিয়েছিল কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদেরও। ৩৪ দিন পর সেই সন্দেশখালিতেই দেখা গেল উলটপুরাণ। এলাকা কাঁপানো তৃণমূল নেতা শাহজাহানের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন মহিলারা। অভিযোগ, রাতের অন্ধকারে মেয়েদের ডেকে নিয়ে গিয়ে পিঠে তৈরি করানো হত। নারী নির্যাতনের অভিযোগ সামনে আসে। লোকসভা ভোটে বিরোধীদের প্রধান ইস্যুও হয়ে ওঠে সন্দেশখালি। সন্দেশখালির এক নির্যাতিতাকেই বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্র থেকে প্রার্থীও করে বিজেপি। চাপের মুখে প্রথমে শাহজাহান পরে তাঁর শাখরেদ উত্তম, শিবুকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আদালত থেকে অনুমতি নিয়ে শাহজাহানকে হেফাজতে নেয় ইডি-সিবিআই। এরই মধ্যে বিজেপি নেতা গঙ্গাধর কয়ালের ভিডিও ভাইরাল হয়। যাতে গঙ্গাধরকে বলতে শোনা যায়, সন্দেশখালিতে নাকি কোনও নির্যাতনই হয়নি, সবটাই বিজেপির তৈরি করা প্লট। আপাতত, বিতর্কিত বিষয়টি আদালতের বিচারাধিন।
নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় জেলে রয়েছেন রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়-সহ শিক্ষা দফতরের একঝাঁক প্রাক্তন পদস্থ আমলা। অনেকে আবার জামিনে মুক্তিও পেয়েছেন। চাকরির দাবিতে মাসের পর মাস রাস্তায় বসে আন্দোলন করছেন চাকরিপ্রার্থীরা। তবে যোগ্য-অযোগ্য বাছাই সমস্যার জেরে গত ২২ এপ্রিল ২০১৬ সালের এসএসসি-র নিয়োগ দুর্নীতি মামলার পুরো প্যানেলটাই বাতিল করে দেন বিচারপতি দেবাংশু বসাক এবং বিচারপতি মহম্মদ শব্বর রশিদির ডিভিশন বেঞ্চ। বাতিল হয়ে যায় ২৬ হাজার শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি। হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে মামলা গড়িয়েছে সূপ্রিমকোর্টে। যোগ্যতা বাছাইয়ের মাপকাঠি ওমআরশিটের সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ভরসা বলতে ‘মেটা ডেটা’! আর সেই ‘মেটা ডেটা’ খুঁজে বার করতে না পারলে যোগ্য-অযোগ্য তালিকা বাছাই করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে সুপ্রিমকোর্ট। মামলার পরবর্তী শুনানি হবে আগামী ৭ জানুয়ারি।
৮ অগস্ট গভীর রাত। আরজি করে নিজের কর্মস্থলেই ধর্ষণ-খুনের শিকার হন দ্বিতীয় বর্ষের ডাক্তারি ছাত্রী। বিচারের দাবিতে এবং সুরক্ষার প্রশ্নে জুনিয়র চিকিৎসকদের টানা কর্মবিরতি, মহিলাদের উদ্যোগে একাধিকবার রাত দখল অভিযান, আন্দোলনের ঢেউ পৌঁছে যায় দেশ বিদেশেও। সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে তদন্ত করছে সিবিআই। তবে ৯০ দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা চার্জশিটে দিতে ব্যর্থ হওয়ায় জামিন পেয়েছেন আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ এবং টালা থানার প্রাক্তন ওসি অভিজিৎ মণ্ডল। নতুন করে মেয়ের খুনের তদন্ত চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন নির্যাতিতার মা-বাবা। কবে বিচার মেলে, সেদিকেই তাকিয়ে সকলে।
সাম্প্রতিক কালে নানা ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে। ট্যাব-কাণ্ডেও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ। রাজ্যের অন্তত ১৫টি জেলায় ছড়িয়েছে ট্যাব কেলেঙ্কারি। পড়ুয়াদের জন্য রাজ্যের বরাদ্দ লক্ষ লক্ষ টাকা পৌঁছে গিয়েছে সাইবার অপরাধীদের হাতে। তা প্রকাশ্যে আসার পর কলকাতায় একাধিক অভিযোগ দায়ের হয়েছে। তার তদন্তে নেমে কলকাতা পুলিশের প্রাথমিক অনুমান, ট্যাব জালিয়াতি চক্রের আঁতুড়ঘর উত্তর দিনাজপুরের চোপড়া এবং তার আশপাশের এলাকা। শুধু তা-ই নয়, গোটা চক্রের মাথা এক জন বলেই আপাতত মনে করছেন লালবাজারের তদন্তকারীরা। ট্যাব কেলেঙ্কারির প্রথম অভিযোগ উঠেছিল পূর্ব বর্ধমানে। ধীরে ধীরে একই অভিযোগ উঠতে শুরু করে অন্যান্য জেলায়।১৫টির বেশি জেলার মোট ১৯৪টি স্কুলের পড়ুয়ারা ট্যাব কেলেঙ্কারির শিকার। বাকি আট জেলা থেকে যদিও সেই রকম কোনও অভিযোগ প্রকাশ্যে আসেনি। তবে প্রশাসনিক আধিকারিকদের একাংশের মত, ট্যাব কেলেঙ্কারি যে ভাবে ছড়িয়েছে, তাতে ওই আট জেলাও তালিকায় যুক্ত হলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
আবাস যোজনার ঘর পাওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন অঞ্চলে সরকারি প্রকল্পে প্রাপকদের তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়া, অনুপযুক্তদের অন্তর্ভুক্ত করা এবং অবৈধভাবে অর্থের বিনিময়ে তালিকাভুক্তির মতো অসংখ্য অভিযোগ উঠেছে। এর ফলে প্রকৃত প্রাপকেরা বঞ্চিত হয়েছে তাদের প্রাপ্য থেকে। ঘর প্রাপকদের ন্যায্যতার দাবিতে সরব হয়েছে বিভিন্ন গ্রাম পঞ্চায়েতের সাধারণ মানুষ। বস্তুত, আবাস যোজনার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রকল্পকে নিয়ে এতবার দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় সাধারণ মানুষদের মধ্যে ক্ষোভ এবছর চরমে ওঠে। প্রকৃত সুবিধাভোগী গরিব মানুষজনের জন্য এই প্রকল্প বরাদ্দ করা হলেও, দুর্নীতি এবং পক্ষপাতের কারণে প্রকৃত প্রাপকদের বঞ্চিত করার অভিযোগ ক্রমশ বাড়ে। সরকার যদিও জানায়, প্রকৃত প্রাপকদের নিশ্চিত করতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে একটি সার্ভে চালু করা হয়েছে, তবে এই সার্ভের নামেও নানা অপব্যবহারের অভিযোগ সামনে এসেছে।
বছরভর এ ধরনের বহু ঘটনার ঘনঘটা লেগে ছিল বাংলায়। সন্দেশখালি থেকে আরজি কর কিংবা চাকরি বাতিল থেকে ট্রাম-ট্যাক্সির বিলুপ্তি ঘিরে বিতর্ক অব্যাহত বর্ষশেষেও। কিংবা বলা ভাল, নিষ্পত্তি না হওয়া এমন বহু ঘটনাকে সঙ্গে নিয়েই শেষ বেলায় পৌঁছেছে ২০২৪ সাল আর শুরুর অপেক্ষায় ২০২৫ সাল।