মিথলজির প্রতি আকর্ষণ চিরকালের। সে ছোট হোক আর বড়, প্রত্যেকেরই রয়েছে মিথলজির প্রতি এক দুর্নিবার আগ্রহ। ইংরেজি মিথলজির সহজ বাংলা অর্থ পুরাণ বা রূপকথা। এককথায় মিথলজি হচ্ছে এমন ধরনের গল্প-কাহিনি, যেখানে কেবল দেব-দেবী এবং সমাজের বীরপুরুষদের কাহীনি বর্ণিত থাকে। প্রত্যেকটি মিথ বা গল্প প্রাকৃতিক অথবা ঐতিহাসিক ঘটনাবলির পিছনের কারণ বর্ণনা করে। এক কথায় দেব-দেবীদের নিয়ে যেকোনো কাহীনিই হচ্ছে মিথ আর সেই সম্পর্কিত বিদ্যা বা পড়ালেখাকে মিথলজি বলে।
বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে আমরা জানি কেন ঝড় বা জলোচ্ছ্বাস হয়, কেন আকাশে বিদুৎ চমকায়, কেনই বা ভূমিকম্পের ফলে বড় বড় অট্টালিকা ভেঙে পড়ে। কিন্তু হাজার হাজার বছর আগে প্রাচীন গ্রিসের মানুষরা এইসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা ঘটনার পিছনে দেব-দেবীদের হাত আছে বলে মনে করত। তারা এইসব প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোকে মনে করত এক একজন দেব-দেবীর শক্তির বহিঃপ্রকাশ। প্রাচীন গ্রিকদের অসংখ্য দেব-দেবীতে বিশ্বাসী ছিল। সেই সব দেব-দেবীরাই হচ্ছে গ্রিক মিথলজির প্রাণ। তার মধ্যে প্রধান ১২ জন দেবতাকে বলা হয় অলিম্পিয়ান। এদের অলিম্পিয়ান বলার কারণ এরা সবাই মাউন্ট অলিম্পাস পর্বতে বাস করত।
গ্রিক দেবতা বললে সবার আগে আমাদের চোখে ভেসে ওঠে উত্তপ্ত বজ্র হাতে পরাক্রমশালী দেবরাজ জিউসের ছবি। কিন্তু জিউস কীভাবে দেবরাজ হলেন এবং জিউসের আগমনের আগে এই পৃথিবীতে কী ছিল? ধর্মানুভূতি চিরকাল মানুষের চিন্তাভাবনার দিককে প্রভাবিত করেছে। গ্রিক সভ্যতা প্রাচীন যেকোনো সভ্যতার চেয়ে ছিল বেশি মানবীয়। এমন একটি সময়ে গ্রিকদের উত্থান হল যখন মানুষের মনে দেবতারা শুধু ভয়ই উদ্রেক করতে পারত। তাদের চোখে দেবতারা ছিল অন্য যে কোনো পার্থিব প্রাণীর চেয়ে আলাদা। যেমন- মিশরের চলৎশক্তিহীন বিড়ালের মাথাযুক্ত একটি অর্ধমানবী। কিন্তু গ্রিকরাই প্রথম এই দেবতাদেরকে দিলেন মানুষের আকৃতি এবং জীবন। তারা দেবতাদেরকে দৈত্য বা ভয় উদ্রেককারী কোনো রাক্ষস হিসেবে দেখলেন না, দেখলেন বন্ধু হিসেবে। একজন মরণশীল মানুষের যত দুর্বলতা আছে তার প্রায় সবই একজন অমর দেবতারও বৈশিষ্ট্য হয়ে গেল। দেবতারা আর মন্দিরে বসে থাকলেন না, বরং তারা ভূতলের মানুষের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেলেন। অনেক সময় মরণশীল মানুষরাও দেবতাদের জীবনে প্রভাব ফেলার সুযোগ পেলেন।
জিউস ছিলেন মহাদেব বা দেবতার দেবতা অর্থাৎ সব দেব-দেবীর রাজা এবং অলিম্পাস পর্বতের সম্রাট। তিনিই মিথলজির প্রধান দেবতা। রোমানরা তাকে জুপিটার বলে ডাকে। খ্রিষ্টপূর্ব ২১০০ সালের দিকে বলকান এলাকার মানুষেরা আবহাওয়ার দেবতা হিসেবে জিউসের পূজা করত। জিউস মূলত আকাশের দেবতা ও সে সূত্রে বৃষ্টিপাতের দেবতা। হোমারের ইলিয়াডে জিউসকে তার বিরুদ্ধাচারীদের দিকে বাজ মারতে দেখা যায়। সুতরাং ধারণা করা হয়, জিউস বজ্রপাত ও আলো নিয়ন্ত্রণ করত। জিউস নামটা মূলত গ্রিক শব্দ ডিউস থেকে এসেছে, যার মূল অর্থ হলো উজ্জ্বলতা। তিনি ছিলেন অলিম্পাসের রাজা। অর্থাৎ কিং অব অলিম্পাস।হেসিয়ডের থিওজেনি অনুসারে, পরিবারের পিতার মতো মাউন্ট অলিম্পাসের অলিম্পিয়ানদের শাসন করতেন জিউস। জিউসের বাবার নাম ছিল ক্রোনাস, রোমানরা যাকে বলে স্যাটার্ন এবং তার মায়ের নাম রেয়া, রোমানরা যাকে বলে অপ্স। মহামান্য জিউসের জন্ম নিয়ে আছে অতি মজার এক কাহিনি।
ক্রোনাস দৈবক্রমে জানতে পারলেন তার স্ত্রীর গর্ভে এক পুত্রের সন্তানের আগমন হবে, যে তাকে সিংহাসনচ্যুত করবে। এরপর থেকে তিনি তার সন্তানদের গিলে ফেলতে লাগলেন। এভাবে তিনি পর পর তার পাঁচ সন্তানকে গিলে ফেলেন। কিন্তু ষষ্টবারে জন্ম হলো জিউসের। এইবার রেয়া শিশুপুত্র জিউসের বদলে এক খণ্ড পাথর কাপড়ে বেঁধে ক্রোনাসের কাছে নিয়ে দিলেন। ক্রোনাস সন্তান ভেবে পাথর খেয়ে ফেললেন। রেয়া তার এই ষষ্ট সন্তানকে ক্রিট দ্বীপে পাঠিয়ে দেন।
জিউসের শৈশব সম্পর্কে একাধিক পরস্পরবিরোধী কাহিনি প্রচলিত আছে। কেউ বলেন, অ্যামালথিয়া নামে একটি ছাগল তাকে প্রতিপালন করে। অন্যদিকে, কোনো কোনো কাহিনিতে বলা হয়, সিনোসুরা নামে এক নিম্ফ তাকে প্রতিপালন করেন। ক্রোনাস যেহেতু পৃথিবী, স্বর্গ ও সমুদ্রের দেবতা ছিলেন, তাই তার কাছ থেকে লুকাতে গিয়ে সেই নিম্ফ একটি দড়ির দোলনায় জিউসকে গাছে ঝুলিয়ে রাখেন, যাতে সে পৃথিবী, সমুদ্র ও আকাশের বাইরে থেকে তার পিতার দৃষ্টির অগোচরে থাকেন। কৃতজ্ঞতাবশত জিউস তাকে নক্ষত্রমণ্ডলীতে স্থান দেন। এজন্যই নক্ষত্রমণ্ডলীর একটি নক্ষত্রের নাম নিম্ফ।