তপন মল্লিক চৌধুরী
কিছুকাল আগেও বাঙালি ধনতেরাসে এমন মেতে উঠত না। কিন্তু এখন তাদের মধ্যেও তেরাস অর্থাৎ ত্রয়োদশীর সময় সোনা, রূপো কেনার ধুম লেগেছে। বাঙালি যখন থেকে সঞ্চয়ী হতে শুরু করলো তখন থেকে বারো মাসে তেরো পার্বণ এর মধ্যে ধনতেরাসও একটি পার্বণ বলে পরিচিত হলো। কার্তিক মাসে কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশীর দিন পালিত এই উৎসব নিয়ে একাধিক গল্পকথা আছে।
এও কথিত আছে, রাজা হিমের ষোড়শবর্ষীয় পুত্রের কোষ্ঠীতে লেখা ছিল বিবাহের চতুর্থ দিবসে তাঁর সর্পাঘাতে মৃত্যু হবে। নতুন পুত্রবধূটি দিশাহারা, কী করবে সে? নববধূ স্বামীকে যমের হাত থেকে বাঁচাতে ভেবে ভেবে এক উপায় বের করল- স্বামীকে কিছুতেই ঘুমাতে দেওয়া যাবে না। যে করেই হোক, তাকে জাগিয়ে রাখতে হবে।
কৃষ্ণা ত্রয়োদশীর অমানিশায় সবাই যখন ঘুমে,তাদের শয্যাকক্ষের চতুর্দিকে নববধূ জ্বালিয়ে দিল রেড়ির তেলের অসংখ্য প্রদীপ। ঘরে একটিমাত্র প্রবেশদ্বার। সেটি বন্ধ থাকলেও সাপ নাকি সেই ক্ষুদ্র রন্ধ্রপথেও ঢুকতে পারে,তাই সে তার সমস্ত সোনার গয়না খুলে স্তূপীকৃত করে রাখল সেই দ্বারপ্রান্তে। প্রদীপের উজ্জ্বল আলোয় সোনার গয়না বিচ্ছুরিত হতে লাগল। সেই জৌলুসে যমের চোখ ধাঁধিয়ে যায় এবং সে যাত্রায় রাজা হিমের ছেলের মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পায়। তারপর থেকেই এই দিনটিকে পালন করা শুরু হয়।

ধনতেরাস নিয়ে আরও একটি কাহিনী রয়েছে। সেটি হল, একসময় দুর্বাশা মুনির অভিশাপে স্বর্গথেকে বিতাড়িত হন লক্ষ্মী। এরপর লক্ষ্মীহীন স্বর্গের দেবতারা রাক্ষসদের সঙ্গে যুদ্ধ করে লক্ষ্মীকে ফিরে পান। সেই দিনটি হল ধনতেরাসের দিন। এই কারণে লক্ষ্মী আরাধনার মাধ্যমে দিওয়ালি সূচনা হয় এবং এই দিনটিকে ধনতেরাস বলে পালন করা হয়।
সমুদ্রমন্থনের সময় ধন দেবী উঠে এসেছিলেন বলেও কথিত আছে। দেব-অসুরের সমুদ্রমন্থনে উঠে এসেছিলেন এই ধন্বন্তরী, এক হাতে অমৃতভাণ্ড ও অন্য হাতে আয়ুর্বেদ নিয়ে। তিনিই শেখালেন আয়ুর্বেদ বা আয়ু-বৃদ্ধির উপায়। পরমায়ুই তো আমাদের একমাত্র ধন। ধনতেরাসে তারই পুজো গহনা কেনা দিয়ে।
দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুতে এইদিন মারুন্দুর উপাসনা হয়। মারুন্দু মানে ওষুধ। বাড়িতে প্রস্তুত করে পরের দিন নরক চতুর্দশীতে সূর্যোদয়ের প্রাক্কালে তা খাওয়ার নিয়ম। বাড়ির মেয়ে-বৌমাকে শেখানো হয় মারুন্দুর রেসিপি, যাতে তারা প্রজন্মের প্রজন্ম ধরে এই ঐতিহ্য বহন করে নিয়ে চলে। যমদেবের উদ্দেশে প্রদীপ জ্বালানো হয়। লক্ষ লক্ষ প্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত হয় ধরণী। জীবনের উদ্দেশে পরমায়ু বৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করা হয়।
এছাড়াও কথিত আছে যে, আজকের দিনে কুবের বিবাহের জন্য খুব দরকারে ভগবান বিষ্ণুর কাছ থেকে কিছু অর্থ ধার নিয়েছিলেন। যে কারণে আজও বহু লোক ভগবান বিষ্ণুর মন্দিরে টাকা দান করেন, যাতে ভগবান বিষ্ণুর কাছে ধার করা অর্থ শোধ করা যায়।

কিন্তু এসবই লোককথা। পাশাপাশি প্রবাদ আছে ধনতেরাসের দিন কোনও ধাতু কিনে ঘরে আনলে সারা বছর সংসারে সমৃদ্ধি বিরাজ করে। সেই প্রবাদকে মাথায় রেখে এই সময়ে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সোনা-রুপোর গয়না থেকে বিভিন্ন ধাতুর বাসনা কেনার চল আছে। কিন্তু এই চলের মধ্যে বছর ২০ আগেও বাঙালিরা ছিল না। বরং কালীপুজোর আগের দিন ভূতচতুর্দশী দিয়েই শুরু হত বাঙালির দীপাবলি। সেদিন সকালের বাজার থেকে বাড়িতে চোদ্দ রকম শাক আসত। তারপর মধ্যাহ্নভোজনের পাতে শুরুতেই পড়ত চোদ্দশাক ভাজা। যার ব্যাখ্যা ছিল এদিন নাকি ‘তেনারা’ সন্ধের পর জাগ্রত হন। তাই তাঁদের হাত থেকে দূরে থাকতে চোদ্দশাক আর বংশের চোদ্দপুরুষের উদ্দেশ্যে চোদ্দ বাতি দেওয়ার মধ্যে দিয়ে হত আলোর উৎসবের সূচনা।
কিন্তু ধনতেরাস কিছুকাল আগে পর্যন্ত বাঙালি খায়, না মাথায় দেয় তাই ভাল করে জানত না। তবে এই ক’বছরের মধ্যে সোনার দোকান থেকে বাসনের দোকানে এক সপ্তাহ আগে থেকে বাঙালির ভিড় জমানো দেখে সত্যি অবাক হতে হয়। অনেকে তো এমনও বলেন যে ঝলমলে ধনতেরাসের রোশনাই না একদিন বাঙালির ভূত চতুর্দশীকে অন্ধকারে ঢেকে দেয়!
2 Comments
আশঙ্কা খুবই সম্ভবনাময়, বাঙালির নব আনন্দে মেতে ওঠা সে পথেই পা বাড়িয়েছে।
এই বাংলার বাঙালি তো আর বাঙালি নেই, তারা মাওয়ালি হয়ে গেছে, তারা এখন মাড়োয়ারিদের চাকর-বাকর, তাই মাড়োয়াড়িরা যা করে বাঙালিরা সেই রাস্তা অন্ধের মতো
অনুসরণ করে।