বছরের পর বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধের পরেও বহাল তবিয়তে টিকে ছিলেন তিনি। কিন্তু সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সিংহাসনটি ছিল লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্ত আর লাশের উপর। স্বৈরশাসক বাশার ২০০০ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন। যদিও আসাদ রাজবংশের উত্থান ঘটেছিল ১৯৭০ সালে। আসাদরা ছিল সংখ্যালঘু আলাউই সম্প্রদায়ের। যারা দীর্ঘদিন ধরে সমাজে বৈষম্য এবং নির্যাতনের শিকার ছিল। তাদের অনেকেই সুন্নিদের থেকে পৃথক হয়ে প্রিথক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিল। বাশারের ঠাকুর্দা ছিলেন সেরকমই একজন আলাউই নেতা। তিনি বিশিষ্ট আলাউই ব্যক্তিদের সঙ্গে ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে চিঠি দিয়ে আলাউইদের জন্য পৃথক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আবেদন জানিয়েছিলেন।ফরাসিরা আলাউই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে না পারলেও সিরিয়া ছেড়ে যাওয়ার পর আলাউইরা স্থানীয় সিরিয়ানদের অনেকের চোখেই বিশ্বাসঘাতক হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। সিরিয়ার স্বাধীনতার পর যখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করতে থাকে, তখন স্বাভাবিকভাবেই আসাদের ঠাকুর্দা হাফেজ এবং তার মতো অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সেসব দলের প্রতি আকৃষ্ট হন।

হাফেজ আল-আসাদ ক্ষমতায় আসেন ১৯৭০ সালে সিরিয়ায় এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে।তখন সিরিয়া ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতায় আক্রান্ত। হাফেজ আল-আসাদ ছিলেন একজন আলাউই মুসলমান। তিনি তাঁর জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ক্ষমতার কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। তিনি সামরিক বাহিনী ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে আলাউইদের প্রভাবশালী অবস্থান তৈরি করেন এবং বিরোধীদের দমন করতে বিভাজনের রাজনীতি ব্যবহার করেন। ২০০০ সালে হাফেজের মৃত্যুর পর তার দ্বিতীয় ছেলে বাশার আল-আসাদ ক্ষমতায় আসেন। বাশারের পিতা হাফিজ আল আসাদ প্রায় ৩০ বছর সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। পিতার হাত থেকে ক্ষমতা নেওয়ার জন্য তাকে তৈরি করা হয়নি। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে তিনিই দেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে, যে যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ মারা গেছেন, বাস্তুচ্যুত হয়েছেন অনেকে। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে প্রেসিডেন্টের পদে আসীন হন বাশার আল আসাদ। কিন্তু দেশটির সংবিধানে প্রেসিডেন্টের সর্বনিন্ম বয়স ৪০ বছর থাকার যে বিধান ছিল তা পরিবর্তন করতে হয়। দায়িত্ব নিয়ে তিনি স্বচ্ছতা, গণতন্ত্র, উন্নয়ন, আধুনিকায়ন, জবাবদিহিতা ও প্রাতিষ্ঠানিক ভাবনার কথা বলেছিলেন। কিন্তু তিনি তার পিতার মতোই কঠোর নীতিতে ফিরে যান। বাশার তাঁর শাসনকালকে আরও শক্তিশালী করতে তার পরিবার ও কাছের সহযোগীদের নিয়ে একটি দল তৈরি করেন। এর মধ্যে ছিলেন তার ভাই মাহের আল-আসাদ ও বোন বুশরার মতো পরিবারের সদস্যরা।

২০০১ সালে নিরাপত্তা বাহিনী ব্যাপক দমন অভিযান চালায় ও বহু সোচ্চার কণ্ঠকে আটক করে। বাশার আল আসাদ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সীমিত সংস্কার করলেও ব্যক্তি খাতে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। তাঁর শাসনে উত্থান হয় তাঁর আরেক ভাই রামি মাখলৌফের। তিনি সম্পদ আর ক্ষমতার সমন্বয়ে বিশাল ব্যবসা সাম্রাজ্য তৈরি করেছেন। ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধকে ঘিরে বাশার আল আসাদের সঙ্গে পশ্চিমাদের সম্পর্কের অবনতি হয়। তিনি ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের বিরোধিতা করেছিলেন। সম্ভবত তার আশংকা ছিল আমেরিকার সামরিক বাহিনীর পরবর্তী টার্গেট সিরিয়া হতে পারে। আমেরিকা সেই সময় ইরাকে তাদের বিরোধীদের কাছে অস্ত্র চোরাচালানে সহায়তার জন্য দামেস্ককে দায়ী করছিল। ওই বছর আমেরিকা সিরিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ২০০৫ সালে লেবাননের প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরি বৈরুতে বিস্ফোরণে নিহত হলে সেই ঘটনায় অনেকে সিরিয়া ও তার সহযোগীদের দিকেই অঙুল ওঠে।

আসাদ ও তার লেবাননের সহযোগী হেজবুল্লাহ অবশ্য ওই হত্যাকাণ্ডে তাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু সংঘাত বেড়ে যাওয়ার পর জাতিসংঘের হিসেবে লাখ লাখ মানুষ হতাহত হয়েছে। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোও জড়িয়ে পড়তে শুরু করে। রাশিয়া, ইরান এবং ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো আসাদের বাহিনীকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে, তুরস্কসহ কিছু উপসাগরীয় দেশ সশস্ত্র বিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দেয়। শুরুতে আসাদ বিরোধীরা গণতন্ত্র ও মুক্তির কথা বললেও দ্রুতই সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টিও উঠে আসে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নিদের বদলে আসাদ নিজের অ্যালাউইটস গোত্রের লোকজনকে সুবিধা দিচ্ছেন বলে অভিযোগ ওঠে। সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সূত্র ধরে অ্যালাউইটসদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় ইসলামপন্থী কিছু গ্রুপ। আবার ইরান সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়ারা আসাদ সরকারকে সমর্থন দেয়। প্রতিবেশী ইরাকে ইসলামিক স্টেট বা আইএসের উত্থান হয়ে গেছে। তারা সিরিয়ারও কিছু জায়গা দখল করে সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় শহর রাক্কাকে রাজধানী ঘোষণা করে।

২০১৩ সালে দামেস্কের কাছে বিরোধী অধ্যুষিত পূর্বাঞ্চলীয় ঘৌতায় রাসায়নিক হামলা হলে শত শত মানুষ মারা যায়। পশ্চিমারা এবং সিরিয়ার বিরোধী গোষ্ঠীগুলো এই হামলার জন্য আসাদ সরকারকে দায়ী করে। তবে দামেস্ক এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে। পরে আন্তর্জাতিক চাপে তারা রাসায়নিক অস্ত্রের মজুদ ধ্বংস করতে রাজী হয়। কিন্তু তাতে করে সিরিয়া যুদ্ধের নৃশংসতা কমেনি। আরও রাসায়নিক হামলা হয়েছে পরবর্তীতে। জাতিসংঘের একটি কমিশন সংঘাতে জড়িত সব পক্ষের বিরুদ্ধেই হত্যা, নির্যাতন ও ধর্ষণের মতো যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ করেছে। ২০১৫ সালে প্রায় পতনের দ্বারপ্রান্তে চলে যায় আসাদ সরকার। দেশের বড় অংশের ওপরই তখন বাশার আল-আসাদে আর কর্তৃত্ব ছিল না। তবে, পরে রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপ পরিস্থিতি পাল্টে যায়, গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো আবার পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন বাশার আল-আসাদ।

২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক সমঝোতার আলোকে সরকারি বাহিনী সিরিয়ার বেশিরভাগ এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। যদিও ইসলামপন্থী বিরোধী গ্রুপগুলো এবং কুর্দি মিলিশিয়ারা দেশটির উত্তর ও উত্তরপূর্ব এলাকায় কিছুটা নিয়ন্ত্রণ রাখতে পেরেছিলো। ওই সমঝোতা আসাদের অবস্থানকে শক্তিশালী করে এবং তিনি আরব কূটনৈতিক অঙ্গনে ফিরে আসেন। ২০২৩ সালে আরব লীগের সদস্যপদ ফিরে পায় সিরিয়া। বেশ কিছু আরব দেশ আবার দামেস্কে দূতাবাস চালু করে। নিজের শাসনের তৃতীয় দশকে দেশের ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট সত্ত্বেও মনে হচ্ছিলো যে প্রেসিডেন্ট তার বড় চ্যালেঞ্জগুলো উতরে গেছেন। তবে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাস ইসরায়েলে হামলা করলে গাজা যুদ্ধের সূচনা হয় যা লেবাননেও ছড়িয়ে পড়ে। যার প্রভাব পড়ে আসাদের সহযোগী হেজবুল্লাহর ওপর। হেজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহও নিহত হন।

লেবাননে যেদিন যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয় সেদিনই বিস্ময়করভাবে হামলা করে দ্রুত আলেপ্পো দখল করে নেয় হায়াত তাহরির আল-শাম বা এইচটিএসের নেতৃত্বে সিরিয়ার বিরোধী গোষ্ঠী। তারা দ্রুত গতিতে এগিয়ে হামা ও অন্য শহরগুলো দখল করে নেয়। দক্ষিণাঞ্চলে তখনো সরকারি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ছিল। কিন্তু আসাদের অবস্থান দ্রুতই নড়বড়ে হয়ে পড়ে, কারণ গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী ইরান ও রাশিয়া তার সহায়তায় এগিয়ে আসতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহীরা দামেস্ক ঢুকে পড়েছে এবং বাশার আল-আসাদ ব্যক্তিগত বিমানে করে অজানা গন্তব্যে চলে গেছেন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন এর মাধ্যমেই অবসান হলো সিরিয়ায় আসাদ পরিবারের ৫৪ বছরের শাসন।

উল্লেখ্য, ২০১১ সালে আরব বসন্তের ঢেউ সিরিয়াতেও আছড়ে পড়ে। সিরিয়ার জনগণ শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের মাধ্যমে গণতান্ত্রিকসংস্কারের দাবি তোলে। কিন্তু বাশার সরকারের কঠোর দমন-পীড়নে এই আন্দোলন রূপ নেয় রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে। বাশার আল-আসাদ রাশিয়া ও ইরানের সামরিক সহায়তায় ক্ষমতায় টিকে থাকেন। রাশিয়ার বিমান হামলা ও ইরানের সামরিক বাহিনী তার শাসনকে রক্ষা করে। তবে, সিরিয়ার জনগণের জন্য এই যুদ্ধ ছিল এক দীর্ঘ দুর্দশার সময়। এবছর বিদ্রোহী সংগঠন হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)-এর নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা সিরিয়ার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করে। অবশেষে, তারা রাজধানী দামাস্কাসে প্রবেশ করে ডিসেম্বরের গোড়ায়। বিদ্রোহীদের এই অভিযান আসাদ সরকারের পতন ঘটায় ৮ ডিসেম্বর।