কলকাতা ব্যুরো: গোটা দেশেই মানুষ ও বন্য প্রাণীর মধ্যে সংঘাত বাড়ছে। গত দু’দশকে ক্রমশ দখল হয়ে যাচ্ছে বন্য প্রাণীর আবাসস্থল। এ রাজ্যের ক্ষেত্রে একদিকে যেমন সুন্দরবনের গভীর অরণ্যে ঘেরা দ্বীপে মানুষ বসবাস বেড়েছে, একই সঙ্গে যোগাযোগের সুবিধা বাড়ায় মানুষ পৌঁছে যাচ্ছে গভীর জঙ্গলে। আর তাতেই নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের।

একইভাবে অন্যদিকে দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে গত দু’দশকে বেড়েছে হাতির উপদ্রব। আবার অন্যদিকে ডুয়ার্সের হাতির পাল এখন অন্যতম মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে মানুষের জীবন জীবিকার ক্ষেত্রে।

একসময় ডুয়ার্স-তরাই হয়ে মেচি নদীর গা ঘেঁষে নেপাল পর্যন্ত ছিল হাতিদের করিডোর। কিন্তু এখন সেই করিডোরের মাঝে মাঝে মানুষের বসতি তৈরি হওয়ায়, হাতিদের স্বাভাবিক বিচরনের পথ রুদ্ধ হয়েছে। আর এ সমস্ত কারণে বাড়ছে মানুষ এবং বন্য প্রাণীর মধ্যে সংঘাত ও সংঘর্ষ। বন্য প্রাণীর সঙ্গে সংঘর্ষে মৃত্যু হলে হোম গার্ডের চাকরি দেওয়ার কথা দেশের মধ্যে প্রথম ঘোষণা করল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। প্রথম দফায় ৪৩৪ জনকে হোম গার্ডের চাকরি দেওয়ার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে নবান্ন। প্রাথমিকভাবে হিসেব বলছে, ২০১৫ থেকে এ বছর অক্টোবর মাস পর্যন্ত ৫৮৪ জন মানুষ বন্য প্রাণীর আক্রমণের মারা গিয়েছেন রাজ্যে।

এ রাজ্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গিয়েছে হাতির আক্রমণে। আর তারপরেই বাঘের আক্রমণে মৃত্যু এ রাজ্যে সবচেয়ে বেশি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই সংঘাত যত দিন যাবে ততই বাড়বে। কারন মানুষ ক্রমশ বন্যপ্রাণীদের চেনা জায়গা, তাদের চলাচলের পথ আবার দখল করছে নিজেদের স্বার্থে। আর এর ফলে ততই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে বাঘ থেকে হাতি, বাইসান, চিতা বাঘের মত বন্য প্রাণীরা। যতটা মানুষ বন জঙ্গল এলাকা দখল করছে, ততই বন্যপ্রাণীরা উল্টে মানুষের কাছাকাছি চলে আসছে। এর ফলে দুপক্ষের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সম্প্রতি একটি গবেষণায় জানা গিয়েছে, হাতি ক্রমশ নিজেদের বংশবৃদ্ধি শুরু করেছে। একইসঙ্গে এ রাজ্যে বাঘের সংখ্যা গত কয়েক বছরের তুলনায় বেড়েছে। আবার এই লকডাউন আবহে পরিযায়ী শ্রমিকরা ঘরে ফিরে আসায় এবং বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকায় তাদের অনেকেই মধু ভাঙতে বা কাঠ কাটতে অথবা মাছের মিন ধরতে চলে যাচ্ছেন সুন্দরবনের গভীরে। তাতে অনেকেই কোর এরিয়ায় চলে যাওয়ায় মুখোমুখি হচ্ছেন বাঘের। বাঘও তাদের নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কায় আক্রমণ করছে মানুষকে। তথ্য বলছে, গত সাত মাসে সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে আক্রান্ত হয়েছেন যত মানুষ, তার আগের বছরে তার অর্ধেক মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন। ফলে বন্যপ্রাণী নিজের নিরাপত্তাহীনতায় আরও বেশি মানুষকে আক্রমণ করছে এটা নিশ্চিত।

বাঘ হাতির সংখ্যা বাড়তে থাকায় একদিকে সন্তুষ্ট প্রাণী রক্ষায় যুক্ত প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলি। কিন্তু এর একটা বিপরীত দিক নিয়েই এখন গবেষকরা চিন্তিত। তাদের মতে, গত এক দশকে এ রাজ্যে হাতির পরিমাণ যেভাবে বেড়েছে, তাতে হাতির থাকার জায়গা ক্রমশ কমে আসছে। ডুয়ার্সে হাতির একসময় ভুটান, নেপাল অবাধ যাতায়াত ছিল করিডোর গুলি ধরে। কিন্তু এখন সেসব করিডোরের অনেকগুলি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। একইসঙ্গে বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, পুরুলিয়ায় দলমা থেকে নেমে আসা হাতিরা ক্রমশ এই এলাকাতেই ঘোরাফেরা করছে খাবারের সন্ধানে। আর তাতেই বাড়ছে মানুষের নিরাপত্তাহীনতা।

বনদপ্তর এর অভিজ্ঞ অফিসাররা বলছেন, যত দিন যাবে, ততই এই মানুষ এবং পশুদের মধ্যে সংঘাতের আবহ আরো দীর্ঘ হবে। কারণ মানুষ ক্রমশই বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল নিজেদের ইচ্ছামত ব্যবহার করছে ফলে এর পরিণতি আরো ভয়ঙ্কর হতে পারে বলে মনে করছেন পরিবেশ কর্মীরাও। ফলে এখন হঠাৎ করে বন্যপ্রাণীর আক্রমণে মৃতদের চাকরি দেওয়ার যে প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিল সরকার, আগামী দিনে এই নতুন পথে আরো কত চাকরি দিতে হয়, তা এখন সরকারি আধিকারিকরা আঁচ করতে পারছেন না বলে মনে করছেন বহু বর্ষীয়ান বনকর্তা।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version