কলকাতা ব্যুরো: শুক্রবার সাতসকালেই গোটা দেশকে চমকে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বিক্ষুব্ধ স্বরকে গুরুত্ব দিতেই কৃষি আইন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বলেই জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু কেন তাঁর সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিল? আপাতত এই প্রশ্নই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে জাতীয় রাজনীতিতে।

বিরোধীরা বলছেন, ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। আর সেই কারণেই একের পর এক জনবিরোধী সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন। তবে এই সিদ্ধান্তের ফলে বোঝা গেলো যে মোদীর দর্পচূর্ণ হয়েছে। তাই মোদীর গায়ে ‘ভীতু’ তকমা সেঁটে প্রচার শুরু করে দিয়েছেন বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা।

কিন্তু সত্যিই কি তাই? তবে কি ভয় পেয়েই এমন সিদ্ধান্ত নিল মোদী সরকার? যিনি ৫৬ ইঞ্চি ছাতির গর্বে গর্বিত হয়ে সাহসী পদক্ষেপে দেশকে স্বাবলম্বী করার কথা বলেন, তিনিই কি শেষ পর্যন্ত কৃষকদের আন্দোলনে ভয় পেয়ে গেলেন?

প্রথমেই একটু পিছনে ফিরে দেখা যাক-

শুরুটা হয়েছিল গত বছরের জুন মাসে। সেপ্টেম্বরে সংসদে প্রয়োজনীয় বিতর্ক এমনকি ভোটাভুটি ছাড়াই নরেন্দ্র মোদী সরকার ধ্বনিভোটে পাশ করিয়ে নিয়েছিল বিতর্কিত তিন কৃষি বিল। রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের সম্মতি পাওয়ার পরে তা পরিণত হয় নয়া আইনে।

প্রথমটি ‘অত্যাবশ্যক পণ্য (সংশোধনী) আইন’ বা ‘দ্য এসেনসিয়াল কমোডিটিজ (অ্যামেডমেন্ট ) অ্যাক্ট’। দ্বিতীয়টি ‘কৃষি পণ্য লেনদেন ও বাণিজ্য উন্নয়ন আইন’ বা ‘ফারমার্স প্রডিউস ট্রেড অ্যান্ড কমার্স (প্রমোশন অ্যান্ড ফ্যাসিলিয়েশন) অ্যাক্ট’। তৃতীয়টি ‘কৃষক সুরক্ষা ও ক্ষমতায়ন (মূল্য এবং কৃষি পরিষেবা সংক্রান্ত) আইন’ বা ‘ফারমার্স (এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড প্রোটেকশন) এগ্রিমেন্ট অন প্রাইস অ্যান্ড ফার্ম সার্ভিসেস অ্যাক্ট’।

কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি ছিল, মূলত তিনটি উদ্দেশ্য পূরণের জন্য এই তিনটি কৃষি আইন কার্যকর করা হচ্ছে।

প্রথমত- কৃষিক্ষেত্রে ফড়ে বা দালালদের আধিপত্য কমিয়ে কৃষকের আয় বাড়ানো।

দ্বিতীয়ত- রাজ্যগুলিতে চুক্তি-ভিত্তিক চাষের ব্যবস্থা আইনসিদ্ধ করা।

তৃতীয়ত- কৃষিপণ্য বিপণন নিয়ে যে আইন রয়েছে তা দূর করে আন্তঃরাজ্য কৃষিপণ্যের অবাধ বাণিজ্যের রাস্তা খুলে দেওয়া।

তবে স্রেফ আন্দোলনের চাপে পড়ে রাষ্ট্রের কর্তারা আইন প্রত্যাহার করছেন। ভারতের ইতিহাসে এই ঘটনা বিরল। এ হেন কাণ্ডটি ঘটিয়ে ফেললেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বিরোধীরা বারবার তাঁকে ‘ফ্যাসিস্ট’ আখ্যা দেয়। কৃষক, শ্রমিক থেকে শুরু করে সংখ্যালঘু, দলিত, সব শ্রেণির মানুষের কন্ঠরোধ করার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। তবে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, দীর্ঘ এক বছর ধরে কৃষকদের আন্দোলনের পরও যাঁদের ঘুম ভাঙেনি, কেন্দ্রের মোদী সরকার হঠাৎ কেন তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করলো?

এর সম্ভাব্য কিছু কারণ পর্যালোচনা করা যাক-

উত্তরপ্রদেশ ও পাঞ্জাব ভোটঃ কৃষি আইন প্রত্যাহারের প্রথম এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারণ অবশ্যই আসন্ন পাঁচ রাজ্যের নির্বাচন। বিশেষ করে পাঞ্জাব এবং উত্তরপ্রদেশে ধাক্কা খাওয়ার আশঙ্কা থেকেই দেরিতে হলেও এমন সিদ্ধান্ত বলে মনে করা হচ্ছে। কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে দিল্লির উপকণ্ঠে অবস্থানকারী কৃষকদের বড় অংশই পাঞ্জাব এবং পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা। তাঁদের মধ্যে শিখ এবং জাঠ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অনেক।

আগামী বছরের গোড়াতেই ওই পাঞ্জাব এবং উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা ভোট। আইন প্রত্যাহার না করলে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে রীতিমতো ধাক্কা খাওয়ার আশঙ্কা ছিল বিজেপির। তবে শুধু তাই নয়, পাঞ্জাবে এমনিতেই দুর্বল গেরুয়া শিবির, কার্যত অস্তিত্বহীন হয়ে যেতে বসেছিল। কৃষি আইন প্রত্যাহার না করলে তার ফলাফল যে মোটেও ভাল হবে না, সেটা সদ্যসমাপ্ত উপনির্বাচনেই টের পেয়েছে গেরুয়া শিবির। সম্ভবত সেকারণেই উত্তরপ্রদেশ এবং পাঞ্জাবের ভোটের আগে ঝুঁকি নিতে চায়নি গেরুয়া থিঙ্ক ট্যাঙ্ক।

ফ্যাসিস্ট তকমা সরানোর চেষ্টাঃ সরকার ফ্যাসিস্ট, বিরোধী স্বরকে গুরুত্ব দেয় না, মোদী একরোখা, একনায়ক। গত সাত বছরে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে এগুলিই ছিল বিরোধীদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ। কিন্তু কৃষি আইন প্রত্যাহার করে প্রধানমন্ত্রী এই সব অভিযোগকে ভ্রান্ত প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন। বোঝাতে চাইলেন, বিরোধীদের কন্ঠস্বর তিনিও শোনেন। নাগরিকদের অভাব অভিযোগকে তিনিও সমান গুরুত্ব দেন। আর শুক্রবার মোদী সরকারের এই জন, কৃষক দরদী এই সিদ্ধান্তের ফলে সরকারের বিরুদ্ধে বড়সড় অস্ত্র খুইয়ে বসল বিরোধীরা।

ভাবমূর্তি বাঁচানোর আপ্রাণ লড়াইঃ স্বাধীনতার ৭৫ তম বর্ষ সরকার যখন উদযাপন করছে, তখন রাজধানীর বুকে দেশের কৃষকদের বিক্ষোভ মোটেই সরকারের জন্য ভালো বিজ্ঞাপন নয়। লাগাতার বিক্ষোভ, একের পর এক কৃষকের মৃত্যু মোদীর ভাবমূর্তিতে বেশ ভালোমতোই ধাক্কা দিচ্ছিল। হাজার চেষ্টা করেও কৃষকদের দিয়ে বিক্ষোভ প্রত্যাহার করানো সম্ভব হয়নি। কৃষকরা মোটামুটি স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, আইন প্রত্যাহার না করলে তাঁরা কিছুতেই এক চুলও সরবেন না। তাই ভাবমূর্তি ফেরাতে কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে একপ্রকার বাধ্যই হলো সরকার।

কৃষকরাই গুরুত্বপূর্ণঃ কৃষকদের একটা বড় অংশ থেকে শুরু করে প্রায় গোটা বিরোধী শিবির দাবি করে আসছিল, তিনটি কৃষি আইন আনার নেপথ্যে মোদী সরকারের আসল উদ্দেশ্য ছিল নিজের কর্পোরেট বন্ধুদের পাশে দাঁড়ানো। কিন্তু আইন প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বুঝিয়ে দিলেন, তিনি সততার সঙ্গে কৃষকদের ভালোই করতে চেয়েছিলেন।

শুক্রবার প্রধানমন্ত্রীকে বলতে শোনা গিয়েছে, আমাদের সরকার ছোট কৃষকদের কথা ভেবে, দেশের কথা ভেবে, গ্রাম এবং গরিবদের উন্নতির কথা ভেবে পূর্ণ সততার সঙ্গে এই আইন এনেছিল। কিন্তু এই সহজ কথা আমাদের হাজার চেষ্টার পরও আমরা কৃষককে বোঝাতে পারিনি। অল্প সংখ্যক কৃষক এর বিরোধিতা করলেও, সেটাই আমাদের কাছে জরুরি।

ছোট কৃষকদের সমবেদনা পাওয়ার চেষ্টা: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বরাবরই বলে এসেছেন, কৃষি আইন তিনি এনেছেন দেশের ৯০ শতাংশ ছোট কৃষকদের কথা ভেবে।শুক্রবার আইন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে মোদী আক্ষেপের সুরে বলেন,কৃষকদের আর্থিক পরিস্থিতির উন্নতিতে আমরা পূর্ণ সততার সঙ্গে কাজ করছি। ছোট কৃষকদের উন্নতির জন্য, তাঁরা আরও শক্তি পাক, সেটা নিশ্চিত করার জন্য তিনটি কৃষি আইন আনা হয়েছিল। কিন্তু, এই সত্য আমরা কিছু কৃষককে বোঝাতে পারিনি। হয়তো আমারই চেষ্টার কোনও ত্রুটি ছিল।

শুধু তাই নয়, যারা যারা এই কৃষি আইনকে সমর্থন করেছেন, তাঁদের কাছে ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছেন মোদী। আসলে, ছোট কৃষকদের প্রধানমন্ত্রী বুঝিয়ে দিতে চাইলেন, আমি আপনাদের জন্যই এটা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আইন প্রত্যাহারে বাধ্য হলাম।

তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, বিধানসভা নির্বাচনের সঙ্গে বিজেপি এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে লোকসভার অঙ্কও কষে ফেলেছে। পঞ্জাব-হরিয়ানা-উত্তরপ্রদেশের ৪০টি লোকসভা আসনে এই কৃষক বিক্ষোভ প্রভাব বিস্তার করছিল। সেই বিক্ষোভকে যদি এই সিদ্ধান্ত প্রশমিত করতে পারে, তাহলে নরেন্দ্র মোদীর টানা তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার রাস্তা প্রশস্ত হবে।

এই সিদ্ধান্ত মোদীর মাস্টারস্ট্রোক নাকি অহঙ্কারের পতনের শুরু, তার উত্তর সময় দেবে। সেই উত্তরই আগামী কয়েকমাস পর ইভিএমবন্দি হবে। তাই সেই ইভিএম খোলা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version