কাশ্মীর উপত্যকার অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র বৈসরন ভ্যালি ভ্রমণপিপাষুদের কাছে ‘মিনি সুইজারল্যান্ড’ নামে পরিচিত। জায়গাটি দক্ষিণ কাশ্মীরের দক্ষিণ অনন্তনাগ জেলার পাহাড়ি শহর পহেলগাঁও থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে। উপত্যকাটি তুষারাবৃত পাহাড়, ঘন দেওদার বন এবং বিস্তৃত সবুজ তৃণভূমি ঘেরা। প্রতি বছর পর্যটকদের ভীড় যেমন হয় অনেক বলিউড ছবিতে বৈসরনকে পটভূমি হিসেবেও দেখা যায়। সেই নয়নাভিরাম পাহাড়ি পর্যটনকেন্দ্রে সন্দেহভাজনরা অন্তত ২৬ জন পর্যটককে হত্যা করে রক্তে ভাসিয়ে দিল পেহেলগাম বা মেষপালকদের উপত্যকার মাটি।

প্রসঙ্গত, বহু বছর ধরে কাশ্মীর উপত্যকার মাটিতে রক্তক্ষরণ লেগেই আছে কিন্তু পর্যটকদের উপর হামলা তুলনায় কম হয়েছে। ১৯৯৫ সালে পেহেলগামে আল-ফারান নামের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী ছ’জন বিদেশি পর্যটককে অপহরণ করে একজনকে খুন করেছিল, একজন পালিয়ে যায়, বাকি চারজনের আর কোনো খোঁজ মেলেনি। ২০০০ সালে পেহেলগামের নুনওয়ান এলাকায় এক হামলায় প্রাণ হারিয়েছিল ৩২ জন। তাঁদের মধ্যে ২১ জন ছিলেন হিন্দু তীর্থযাত্রী। ২০০১ সালে একই এলাকায় শেশনাগ হ্রদের কাছে আরেক হামলায় নিহত হয় ১৩ জন। তাঁদের মধ্যে ১১ জন ছিলেন তীর্থযাত্রী, বাকি দুজন স্থানীয় বাসিন্দা। ২০১৭ সালে অনন্তনাগ জেলায় গোলাগুলিতে হত হয় ৮ জন হিন্দু তীর্থযাত্রী। এরপর ২০২৪-এর জুন মাসে জম্মুর দক্ষিণাংশের কাঠুয়ায় এক তীর্থযাত্রীবাহী বাসে হামলার কারণে বাসটি খাদে পড়ে গেলে ৮ জন তীর্থযাত্রী নিহত হন।

২৬ জন পর্যটককে হত্যার ঘটনার তীব্র নিন্দা করছেন কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনীতিক নেতারা। তাঁদের স্পষ্ট বক্তব্য, এই ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হল কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ। কাশ্মীরের অর্থনীতিতে পর্যটনের ভূমিকা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। এই ঘটনায় ফের বিরাট ধাক্কা খেল সেই পর্যটন। অর্থাৎ যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে তারা যেই হোক, তারা কাশ্মীরিদের অর্থনীতি কিংবা সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনকে ধ্বংস করতে চায়। আর গত কয়েক মাস ধরে সরকার যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসার প্রচার চালাচ্ছে, তা যে কত বড় ভুয়ো তা ফের একবার প্রমাণিত হল। পর্যটকের ভিড়কে শাসকদল রাজনৈতিক বার্তা হিসেবে ব্যবহার করে বলে এসেছে, কাশ্মীরে শান্তি ফিরে এসেছে। বস্তুত পেহেলগামে হামলার আগেও কি কাশ্মীরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল? ২০১৯ সালে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল হওয়ার পর থেকে সেখানকার রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ মানুষের উপর কঠোর দমন-পীড়ন চলেছে। হাজার হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার হয়েছে এমন সব আইনে, যেগুলির আওতায় কাউকে বিচারের আগেই দীর্ঘদিন আটক রাখা যায়। ২০২৪-এর অক্টোবরে প্রায় এক দশক পর কাশ্মীরে স্থানীয়ভাবে নির্বাচনে স্বায়ত্তশাসন ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতিতে জনপ্রিয় প্রাদেশিক রাজনীতিক ওমর আবদুল্লাহ বড় জয় পেলেও তিনি প্রকৃতপক্ষে খুব সীমিত ক্ষমতা পেয়েছেন। কারণ, কেন্দ্রীয় সরকার মনোনীত লেফটেন্যান্ট গভর্নর সেখানে বড় সিদ্ধান্তের ক্ষমতা নিজের হাতে রেখেছেন।

পেহেলগামে হামলার পর কাশ্মীরের হোটেল ব্যবসায়ী ও ট্যুর অপারেটররা পর্যটকদের পাশে যেমন দাঁড়িয়েছেন তারা হামলাকারীদের তীব্র নিন্দাও করছেন। পরের দিন তারা বিক্ষোভ ও স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালন করে। হামলার ঘটনায় গভীরভাবে শোকাহত সাধারণ বাসিন্দারা। অন্যদিকে হামলার পর রামবান এলাকায় ভূমিধসের কারণে কাশ্মীর উপত্যকার সঙ্গে জম্মুর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় পর্যটকেরা আটকে পড়লে বিমান সংস্থাগুলি ভাড়াও অনেক বাড়িয়ে দেয়। এই অবস্থায় কিন্তু আতঙ্কগ্রস্ত পর্যটকদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন স্থানীয় মানুষ পর্যটকদের তাদের বাড়িতে থাকার জায়গা এবং খাবার দিয়ে তাদের অতিথিপরায়ণতা এবং আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু এর পর আগামী দশ বছরে যে কোনো পর্যটক কাশ্মীরে বেড়াতে আসবেন না সেটা বাস্তব সত্য। এখন প্রশ্ন, কাশ্মীরের এই রক্তাত্ত ঘটনাকে কি কেবলমাত্র সন্ত্রাসবাদী হামলা কিংবা জঙ্গি আক্রমণ অথবা মুসলমান আতঙ্কবাদীদের হিন্দু পর্যটকদের উপর নৃশংসতা ইত্যাদি উত্তপ্ত আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ রাখবো? দশকের পর দশক পেরিয়ে গেলেও কাশ্মীরে রক্তপাত বন্ধ হয়নি। প্রত্যেকবারই জঙ্গি হামলা অথবা সন্ত্রাসবাদীদের আক্রমন বলে উপত্যকাকে সেনা ছাউনিতে পরিণত করা হয়েছে। হামলা বা সন্ত্রাস রুখতে সেনাবাহিনির সক্রিয়তায় নতুন করে রক্তাত্ত হয়েছে উপত্যকার সাধারণ নাগরিক জীবন।

লক্ষ্যনীয়, পেহেলগামের সন্ত্রাসী হামলায় এবার সন্ত্রাসবাদীরা শুধুমাত্র পুরুষদের হত্যা করেছে, কিন্তু কেন তারা মেয়ে ও শিশুদের ছেড়ে দিল। জঙ্গিদের আক্রমন থেকে কি কোনোদিন ছাড় পায়? না, তাহলে? খুন করার আগে জঙ্গিরা ধর্ম জানতে চেয়েছে, হিন্দু কিনা তা যাচাই করে নিয়েছে। আসলে কেবলমাত্র খুন বা সন্ত্রাস নয়, ধর্ম জেনে পুরুষদের বেছে বেছে কপালে গুলি করা আর তাদের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের ছেড়ে দেওয়া যাতে তারা ফিরে গিয়ে এই কথাগুলি জানাতে পারে যে ধর্ম জানতে চাওয়া হয়েছে। একে কি শুধুমাত্র সন্ত্রাস বা হত্যাকাণ্ড বলবো? এটি এমন একটি পরিকল্পিত হামলা যা কেবল সন্ত্রাস নয়, দেশ ও সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করবে। যে বিভাজনে কেবলমাত্র ধর্মের কারণেই মানুষে মানুষে সন্দেহ, ভয় ও ঘৃণার জন্ম হবে। ঘৃণা থেকে বিভেদ সৃষ্টি হলে মানুষ হিন্দু-মুসলিম ধর্মের বিতর্কে ডুবে নিরাপত্তায় এত গলদ কেন, এই প্রশ্ন করতেই ভুলে যাবে? ভুলে যাবে কড়া নিরাপত্তার মধ্যেও সন্ত্রাসবাদীরা কীভাবে কোথা থেকে এল? কোথায় ইন্টেলিজেন্স ইনপুট? আসলে এই ঘটনা যে কেবল সন্ত্রাসবাদী হামলা নয়, এটি একটি গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। যে ষড়যন্ত্রে মানুষ হিন্দু বনাম মুসলিম বিতর্কে ডুবে যাবে। সেকারণেই ধর্ম জানতে চাওয়া আর বার্তা পাঠাতে মেয়েদের ছেড়ে দেওয়া। ধর্মীয় বিদ্বেষ দিয়ে কেবল ভয় ছড়ানো নয়, বিভাজন বিদ্বেষ দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলা যায়। আর এই মুহুর্তে ঠিক সেটাই চলছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ধর্মীয় বিতর্ক তুঙ্গে উঠেছে, শাসকের বিরুদ্ধে নাগরিক নিরাপত্তার কোনো প্রশ্ন নেই- কে জঙ্গি, কেন জঙ্গি, কারা সন্ত্রাসবাদী কেন তারা আতঙ্কবাদী এমন কোনো প্রশ্ন নেই, কেবল বিভেদ বিভাজন নিয়ে উত্তাপ ছড়ানো আর সেই উত্তাপে শাসকদল হাত সেঁকছে। আর আমরা মৃতদেহের উপর দাঁড়িয়ে নিজেদের ঐক্য, সমতাকে কেবল ভেঙেই চলেছি।
