পৃথিবীর মানব সভ্যতার ইতিহাসে নরবলি দেওয়ার অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। অনেক সভ্যতায় প্রকৃতি কিংবা দেবদেবীকে খুশি করবার জন্য একসময় নরবলির প্রচলন ছিল। কিন্তু আজ থেকে ৫০০ বছর আগে পেরুতে চিমু নামে যে সভ্যতার উল্লেখ পাওয়া যায় সেখানে নারকীয় শিশুবলির যে দৃষ্টান্ত পেলে তা আর কোথাও পাওয়া যায় না। কিছুকাল আগে পর্যন্ত পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় শিশুবলির ঘটনা হিসেবে দেখা হত মেক্সিকো সিটির টেম্পল মায়োরে ৪২ জন শিশুকে উৎসর্গ করবার সেই নৃশংস ঘটনাকে। কিন্তু চিমু সভ্যতার শিশুবলি যে কোনো নৃশংসতাকে ছাপিয়ে যায়। প্রত্নতাত্ত্বিকরা বহু গবেষণা করেও কোনো লিখিত দলিল কিংবা প্রমান খুঁজে পাননি যাতে এই শিশুহত্যা সম্পর্কে কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তবে কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক দলিল থেকে এটা জানা যায় যে, ইনকা সভ্যতায় শত শত শিশুবলি দেওয়া হত কোনো রাজার মৃত্যুর পর। কিন্তু চিমুরা ঠিক কী কারণে শিশুবলি দিত তার কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক দলিল পাওয়া যায়নি। তবে উত্তর পেরুর প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলে চিমোর অঞ্চলে যেসব শিশুদের কংকাল উদ্ধার হয়, সেখানে শুকনো কাদামাটির স্তুপ পাওয়া যায়। যে শুকনো কাদামাটি এককালে এখানকার অতিবৃষ্টির ইঙ্গিত দেয়। তাই প্রত্নতাত্ত্বিকরা ধারণা করেন, কোনো এককালে এখানে অতিবৃষ্টির কারণে কিংবা এমন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কৃষিকাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল এবং ফসল উৎপাদন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। হয়তো বা এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, যাতে চিমু সভ্যতা ধ্বংসের মুখে পড়েছিল, আর তাই নিজেদের সভ্যতা রক্ষায় তারা তাদের শিশুদের বিসর্জন দিয়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিকরা ধারণা করেন, সেই সময়কার চিমু জাতির শাসক কিংবা ধর্ম গুরুরা নিজেদের বৃহত্তর স্বার্থের জন্যই এই উৎসর্গের নির্দেশ দেন।
চিমু সভ্যতার মানুষেরা ছিল চন্দ্র উপাসক। অর্থাৎ তারা চন্দ্রের পূজা করত। চন্দ্র, প্রকৃতি ও দেবতাকে সন্তুষ্ট করতে তারা বিভিন্ন মূল্যবান সামগ্রী উৎসর্গ করত। এটাই ছিল তাদের ধর্মাচরণের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। চিমু সভ্যতার মূল ভিত্তি ছিল কৃষিকাজ ও মাছ ধরা। কৃষিকাজের জন্য মোচে নদী থেকে জলসেচের মাধ্যমে তারা প্রায় ৫০ হাজার একর জমিতে চাষের ব্যবস্থা করেছিল। তাদের মূল ফসল ছিল ভুট্টা ও তুলা। চিমু সভ্যতার সময় মৃৎশিল্পের বেশ বিকাশ ঘটেছিল। চিমুদের তৈরি মৃৎপাত্রগুলি একটু ছিল একটু অন্য ধরনের। যেগুলি দেখতে হত কোনো না কোনো জীবজন্তুর মতো। এছাড়া ছ’তলযুক্ত কোনো বোতল বা পাত্রের উপরে কোনো দাঁড়িয়ে বা বসে থাকা ব্যক্তির মূর্তিও অনেকসময় দেখতে পাওয়া যায়। চিমু মৃৎপাত্রগুলির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, এতে কালো রঙের ব্যবহার। মৃৎশিল্পের পাশাপাশি বিভিন্ন মূল্যবান ধাতু ব্যবহার করত তারা। মূলত সোনা, রুপা ও তামার মিশ্রণে তৈরি সংকর ধাতুর ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। চিমু সভ্যতার রাজধানী ও প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল চান চান। ধারণা করা হয়, এই শহরে এক লক্ষাধিক মানুষ বাস করত। সেই হিসেবে এককালে বর্তমান দক্ষিণ আমেরিকার বৃহত্তম শহর ছিল এই চান চান। পেরুর এই শহরটি পুরোটাই মাটির তৈরি। শহরটিতে ইটের তৈরি বিশাল বিশাল প্রাসাদ দেখতে পাওয়া যায়। ১৪৭০ সালে তাদের শেষ রাজা মিনচামাঙ্কামানের পতন ঘটে ও ইনকা সম্রাট তুপাক ইনকা ইউপানাকির বাহিনী চিমুদের এলাকা দখল করে তাকে ইনকা সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে। এই অঞ্চলে স্পেনীয়দের আগমণের পঞ্চাশ বছর আগের যুদ্ধে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে চিমুদের অস্তিত্বের বিলোপ ঘটে। চিমুদের অস্তিত্বের বিলোপ ঘটলেও তারা এই পৃথিবীতে আজীবনের জন্য রেখে যায় এক নারকীয় শিশু হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস।
পুরাতাত্ত্বিকরা এই শহরেই শিশু বলির সন্ধান পান। ২০১১ সালে ৩,৫০০ বছরের পুরনো একটি মন্দিরের কাছ থেকে ৪২টি শিশু ও ৭৬টি লামার দেহাবশেষ উদ্ধারের পরই অভিযান শুরু করে দলটি। অভিযানের চূড়ান্ত হিসাব অনুযায়ী সেই সময় বলি দেওয়া ১৪০ জন শিশুর কংকাল উদ্ধার করা হয়, যাদের বয়স ছিল ৫-১৪ বছর। তবে বেশিরভাগেরই বয়স ছিল ৮-১২ বছরের মধ্যে। অনেক শিশুর হাড় কেটে ফেলার চিহ্ন দেখা যায়। বুকের পাঁজর ও হাড় দেখেই শনাক্ত করা হয় যে, এগুলো শিশুদের দেহাবশেষ। অনেক কংকালের পাঁজর নষ্ট হয়ে গিয়েছে। মনে করা হয়, এই শিশুদের হৃৎপিণ্ড খুবলে নেওয়া হয়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, ২৬৯ জন শিশুকে এমন নারকীয় হত্যাযজ্ঞের শিকার হতে হয়েছিল। মানব ইতিহাসে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কথা শোনামাত্র প্রথম যে প্রশ্নটি মনে আসে, তা হল, কী অপরাধ করেছিল ওই শিশুরা? চিমু সভ্যতার এই শিশুবলি নিয়ে ঐতিহাসিকদের গবেষণা ও অনুসন্ধান চলছে। ঠিক কী হয়েছিল চিমু সভ্যতার ওই শিশুদের সঙ্গে তা একদিন নিশ্চয় জানা যাবে। কিন্তু যে শিশুদের বলি দেওয়া হয়েছিল, তারা মানব সভ্যতার ইতিহাসের নৃশংসতম এক হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী হয়েই রয়ে যাবে।