অচিনপুর

কোথায় তৈরি হয়েছিল বেহুলার বাসরঘর

By admin

February 13, 2025

লোককথা অনুযায়ী বেহুলার বাসরঘর তৈরি হয়েছিল বগুড়ার মহাস্থানগড়ে, যেখানে লখিন্দরকে সাপে কেটেছিল। কিন্তু মনসামঙ্গল যে অঞ্চলের কথা বলে তার সঙ্গে বগুড়ার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়না। বরং বাংলাদেশের অন্যতম প্রত্নস্থান মহাস্থানগড়ের সঙ্গে বৌদ্ধ যুগের স্থাপনার অনেক মিল পাওয়া যায়। অনেকেই মনে করেন, সম্রাট অশোক এটি নির্মাণ করেছিলেন। আবার মহাস্থানগড় মৌর্য যুগের স্থাপনা নয় এমন কথাও বলেন কেউ কেউ। প্রত্নতাত্ত্বিকরা ১৯৩৪-৩৬ সালে মহাস্থানগড় এলাকায় খননকার্য চালিয়ে দেখেন অনেকখানি জায়গাজুড়ে ১৭২টি কুঠুরি রয়েছে। মহাস্থানগড় গোকুল গ্রামে অবস্থানের কারণে এর নাম গোকুল মেধ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনী। প্রত্নতাত্ত্বিকরা জানাচ্ছেন, মহাস্থানগড়ের সঙ্গে ষষ্ঠ ও সপ্তদশ শতাব্দীর বৌদ্ধ স্থাপনার মিল রয়েছে। সেই মিল কেবল গঠনগত নয়, সেখানে পাওয়া নানা টেরাকোটার জন্যও প্রত্নতাত্ত্বিকরা গুরুত্ব দিয়েছেন। ননীগোপাল মজুমদারের অধীনে এখানকার খননকার্যে বেশকিছু টেরাকোটা পাওয়া যায়, সেই টেরাকোটাগুলি ছিল গুপ্ত যুগের। গোকুল মেধে পাওয়া টেরাকোটাগুলি ছিল গুপ্ত যুগের শেষের দিককার। সেই জন্য ধরে নেওয়া হয় গোকুল মেধ ষষ্ঠ শতাব্দীতে তৈরি। এভাবে দেখলে আবার মৌর্য আমল কিংবা অশোকের সময়ে তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।

১৯৪০ সালে পূর্ববঙ্গ রেলপথের প্রচার বিভাগ থেকে প্রকাশিত বাংলার ভ্রমণ বই থেকে পাওয়া যাচ্ছে, ‘মহাস্থান হইতে ৪ মাইল পশ্চিমে বিহার নামে গ্রামে ও পার্শ্বেই ভাসোয়া বিহার যা ভাসুবিহার গ্রামে পুরাতন বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসাবশেষ অবস্থিত। সপ্তম শতাব্দীতে য়ুয়ান চোয়াং যখন পুণ্ড্রবর্ধনে আগমন করেন, তখন এই স্থানে তিনি একটি গগনস্পর্শী চূড়াসমন্বিত বৌদ্ধবিহার দেখিয়াছিলেন। তিনি ইহাকে পো-শি-পো বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। এই সঙ্ঘারামে মহাযান সম্প্রদায়ের ৭০০ ভিক্ষু ও বহু বিখ্যাত শ্রমণ অবস্থান করিতেন।’ গোকুল মেধ নিয়ে একথাও পাওয়া যায়, ‘মহাস্থানের অতি নিকটে দক্ষিণ দিকে গোকুল নামক গ্রাম অবস্থিত। এখানেও একটি প্রকাণ্ড ধ্বংসস্তূপ আবিষ্কৃত হইয়াছে। ইহা ‘গোকুলের মেঢ়’ নামে পরিচিত। এই স্তূপটিও একটি বৌদ্ধ দেবায়তন ছিল বলিয়া অনুমিত হয়। ইহার প্রাচীর গাত্রে টালির উপর মানুষ, জীবজন্তু, লতাপাতা প্রভৃতির চিত্র উৎকীর্ণ আছে। ইহার শিল্প পদ্ধতি দেখিয়া প্রত্নতাত্ত্বিকগণ অনুমান করেন যে আনুমানিক ঘষ্ঠ অথবা সপ্তম শতাব্দীতে গুপ্তযুগে এই মন্দিরটি নির্ম্মিত হইয়াছিল।’

তার মানে, বেহুলা-লখিন্দরের গল্প তৈরি হওয়ার আগেই এই স্তূপ তৈরি হয়েছিল। তবে পরে এর সঙ্গে যোগ হয়, গোকুল গ্রামের আশপাশে কয়েকটি গ্রামের নাম, কালীদহ নদী, এই কারণেও চাঁদ সওদাগর মনসার গল্পের সঙ্গে জুড়ে যেতে পারে। এছাড়া এই জায়গা থেকে মনসার মূর্তিও পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু সেগুলি যে মনসারই মূর্তি সেকথা সবাই মানেন না। কারণ সাপ পুজো অনেক পুরনো প্রথা। মনসামঙ্গলের সঙ্গে গোকুল গ্রামের যোগ খুব জরুরি নয়। এদিকে গত শতাব্দীর শেষের দিকে ফ্রান্স ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে মহাস্থানগড়ে ফের খনন চলে। যৌথ গবেষণাপত্র জানাচ্ছে, গোকুল মেধের কাছাকাছি কিছু অঞ্চল মূলত পাল আমলের। তারা লিখেছেন, ‘গোকুল মেধের আশেপাশের অঞ্চলটি বেষ্টিত কাঠামোগত অবশেষ এবং অসংখ্য কৃত্রিম পুকুর (ট্যাঙ্ক) সহ ঢিবির অবশেষ দিয়ে। মহাস্থানগড়ের দক্ষিণ-পশ্চিমে আরও দুটি খুব বড় ঢিবি যা একটি বিশাল কাঠামোর মতো প্যাটার্নের ছবি ফুটিয়ে তোলে যার সঙ্গে বসবাসের ঢিবি এবং কৃত্রিম পুকুর রয়েছে।…’  

কিন্তু এই স্থাপনাগুলি পাল শাসনামলে (৭৫০-১১৬১ খ্রিস্টাব্দ) তৈরি এমনটাও বলা যায় না। হতে পারে পালেরা স্থাপনাগুলির সংস্কার করেছিল। যেহেতেু মহাস্থানগড় ও আশপাশের কথা বিদেশী পর্যটক আগেই ভ্রমণ কাহিনীতে এর কথা লিখে গিয়েছেন, তা থেকে বোঝাই যায় কবে তৈরি হয়েছিল। তারপর আরও সংস্কার হয়, তবে পাহাড়পুরসহ গোকুল মেধে পাল আমলের ছাপ যে আছে তা স্পষ্টই উল্লেখ করা হয়েছে। গবেষণা এও বলছে, ‘পাল যুগে বৃহত্তর বাংলার পশ্চিম অংশ জুড়ে বৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি ঘটেছিল, যা পালদের ধর্মীয় মঠ (যেমন পাহাড়পুর), উত্তর-পশ্চিমে মঠ সহ একটি ধর্মীয় এলাকা এবং দক্ষিণে যেমন গোকুল মেধের চারপাশে আধা-স্বায়ত্তশাসিত সম্প্রদায়ের একটি অঞ্চল গড়ে উঠেছিল।…’ প্রশ্ন, তাহলে ত্রয়োদশ বা চতুর্দশ শতাব্দীর ঘটনার সঙ্গে কেন যুক্ত হলো এই স্থাপনা? আসলে লোককথার সঙ্গে বাস্তবতা অনেক সময়ই জুড়ে যায়। ইতিহাসের সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক যুক্তি তর্কের, সাহিত্য থেকে ইতিহাস যেমন অনেক তথ্য পায়, আবার অনেকেই জনপ্রিয় প্রাচীন সাহিত্য ও ইতিহাস গুলিয়ে ফেলে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বহুল প্রচলিত বা প্রিয় কোনো সাহিত্যের চরিত্র ও ঘটনাগুলিকে সত্য বলে ধরে নেয় অতীতে তাদের অস্তিত্ব ছিল বলে বিশ্বাস করে।

নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদী ছাড়াও অসংখ্য খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, তার মধ্যে সাপ খুবই পরিচিত একটি সরীসৃপ, আবার একটি আতঙ্কের নামও। বিষাক্ত সাপের কামড়ে প্রতি বছর বহু মানুষের প্রাণনাশ হয়। তাই সাপকেন্দ্রিক গল্প-কথা-কাহিনী বাংলার সমস্ত মানুষকে আকৃষ্ট করে। মনসামঙ্গল যুগ যুগ ধরে বাংলায় জনপ্রিয়। এই কাব্যে বিধৃত গল্প বাংলার কারও অজানা নয়। চতুর্দশ শতাব্দীতে রচিত এই কাব্যে বিধৃত বেহুলা লখিন্দরের বাসরঘর হিসেবে ঠিক কবে থেকে গোকুল মেধকে জনসাধারণ চিহ্নিত করে আসছে সেই প্রশ্নের থেকে গোকুল মেধকেই বাসরঘর বলার পিছনে আদৌ কোনো যুক্তি আছে কিনা তার জন্য গোকুল মেধের প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ মনে হয় দরকার। বগুড়া সদর উপজেলায় অন্তর্ভুক্ত গোকুল গ্রামে অবস্থিত প্রত্নস্থল মহাস্থানগড় থেকে দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে ১৯৩৪-৩৬ সালে ননী গোপাল মজুমদারের খননে ইটের তৈরি একটি বিশাল স্থাপনার উন্মোচন হয়। গবেষকদের মতে, নবম শতাব্দীতে (পাল যুগ) এখানে একটি বৌদ্ধ মঠ নির্মিত হয়েছিল। এখানে ছয়-সাত শতকের (পরবর্তী গুপ্ত যুগের) কিছু পোড়ামাটির ফলক পাওয়া গেছে। পরবর্তী সময়ে এগারো-বারো শতকের দিকে (সেন যুগে) এখানে বারান্দাসহ একটি শিব মন্দির তৈরি করা হয়। এ মন্দিরে বহু গর্তযুক্ত একটি ছোট পাথরের টুকরোর সঙ্গে ষাঁড়ের প্রতিকৃতি উৎকীর্ণ একটি সোনার পাত পাওয়া গেছে। এ থেকে ধারণা করা হয় যে এটি একটি শিব মন্দির ছিল। তবে বর্তমানে গোকুল মেধ বলতে যেটুকু দেখা যায় তা কেবলই স্থাপনাটির ভিত্তির অংশ। কালের বিবর্তনে মূল স্থাপনাটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ বেহুলা-লখিন্দরের বাসরঘর হিসেবে এর কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি।