জুনিয়র ডাক্তাররা ১০ দফা দাবি পূরণের জন্য সোমবার পর্যন্ত ডেডলাইন বেঁধে দিয়েছিলেন। দাবিগুলি না-মিটলে মঙ্গলবার রাজ্যের সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে জুনিয়র-সিনিয়র নির্বিশেষে সব ডাক্তার সর্বাত্মক ধর্মঘটে সামিল হবেন বলে জানিয়েছিলেন। তাতে যে গোটা রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিবেষা সামগ্রিক ভাবে ভেঙে পড়বে সে কথা বলাই বাহুল্য। এই আবহে শনিবার দুপুর ২টো নাগাদ ধর্মতলায় জুনিয়র ডাক্তারদের অনশন মঞ্চে রাজ্য সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে হাজির হন মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ট্র্যাফিক), ডিসি (সেন্ট্রাল)। মঞ্চে অনশনরত ডাক্তারদের চৌকিতে বসেই মুখ্যসচিব কথা বলেন আন্দোলনকারীদের সঙ্গে। তিনি তাঁদের দাবিদাওয়াগুলি শুনে তা নিয়ে রাজ্য সরকার কী কী পদক্ষেপ করেছে, সেগুলি জানান। কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলার পরে মুখ্যসচিবের মোবাইলে ফোন করেন মুখ্যমন্ত্রী। তারপরে মাইকের সামনে সেই মোবাইল ধরে তাঁর সঙ্গে কথা বলেন জুনিয়র ডাক্তাররা। আন্দোলনকারীরা তাঁদের দাবি নিয়ে সম্ভব হলে এ দিনই বৈঠকে বসার প্রস্তাব দেন মুখ্যমন্ত্রীকে। তিনি তাঁদের জানান, তাঁর ব্যস্ত শিডিউলের মধ্যেও জুনিয়ার ডাক্তারদের সঙ্গে বৈঠক করবেন সোমবার বিকেল ৫টায় নবান্নে।

কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথোপকথনের পর জুনিয়র ডাক্তাদের মনে হয়েছে তিনি হয়ত জানেনই না ঠিক কোন-কোন দাবি নিয়ে জুনিয়ার ডাক্তাররা সরব। আন্দোলনকারীরা সাংবাদিক বৈঠক করে সে কথা জানাতে বাধ্য হন। তাঁরা বলেন, মুখ্যমন্ত্রীর কথা এবং বলার ধরন শুনে আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তাররা খুবই কষ্ট পেয়েছেন। কারণ, এ দিন যখন ফোনে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে জুনিয়র চিকিৎসকরা কথা বলেন সেই সময় তিনি প্রশ্ন করেন ‘তোমাদের কী কী দাবি রয়েছে আমাকে একবার বলো তো…’। এখানেই জুনিয়র ডাক্তারদের প্রশ্ন, এতদিন ধরে দশ দফা দাবি নিয়ে তাঁরা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, অথচ সেই বিষয়টিই জানেন না মুখ্যমন্ত্রী, আজ তাঁকে জানতে হচ্ছে কী কী দাবি? এর থেকে দুঃখের বা হতাশার আর হতে পারে। অনশনকারী জুনিয়ার ডাক্তারদের পক্ষ থেকে অনশনকারী রুমেলিকা কুমার সাংবাদিকদের বলেন, “খুব দুর্ভাগ্যজনকভাবে ও খুব বেদনাদায়ক ভাবে আমরা যখন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীকে জানাচ্ছি যে আমাদের কিছু সুস্পষ্ট দশটি দাবি আছে। আমাদের মনে হল উনি জানেন না দশটা কী দাবি। এখান থেকে প্রশ্ন উঠছে, আমাদের দশ দাবি নিয়ে বারংবার সোচ্চার হওয়ার পর, এমনকি মেইল করার পর আজ কী কী দাবি তা জানতে চাওয়া হল। অথচ এই দাবিগুলির কথা লাগাতারভাবে জানিয়ে চলেছি। তারপরও ৭১ দিন পর আমাদের কেন শুনতে হচ্ছে মাননীয়া জানেন না দাবিগুলি কী? তাহলে কি তাঁকে দাবি জানানো হচ্ছে না?”

এদিকে শনিবার দুপুরে যে ‘ন্যায়বিচার যাত্রা’র ডাক দেওয়া হয়েছিল নাগরিক সমাজ সোদপুর থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত সেই ‘ন্যায়বিচার যাত্রা’র মিছিল সফল করেন। তার আগেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জুনিয়র ডাক্তারদের বললেন, ‘সময়ে আসতে হবে। ১০ জনের বেশি যেন কেউ না যান’। পাল্টা জুনিয়র ডাক্তারেরা বলেন, “আমরা সোমবার মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকে যাব। উনি আমাদের দাবি মেনে নিন। আমরাও কাজে ফিরতে চাই। নির্দেশিকা বের করার জন্য গত ১৪ দিন ধরে অনশনে বসে আছি”। মুখ্যসচিবের মাধ্যমে টেলিফোনে জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে বহুক্ষণ কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী। জুনিয়র ডাক্তারদের কাছ থেকে দশ দফা দাবি শুনতে চান তিনি। তবে জুনিয়র ডাক্তাররা আট দফা দাবি শোনানোর পর জানান, বাকি দু’দফা দাবি বৈঠকের টেবিলে তাঁরা বলবেন মুখ্যমন্ত্রীকে। এই কথার আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চিকিৎসকদের বলেন, “অনুরোধ করছি। অনশন তুলুন। আমি দিদি হিসেবে বলছি। আন্দোলন থেকে সরে এসো। কাজে যোগ দাও। আমি মানবিকতার পক্ষে। আমিও জাস্টিস চাই। কিন্তু হাসপাতালে যদি সাধারণ মানুষ পরিষেবা না পান তাঁরা কোথায় যাবেন? আদালতে মামলা চলছে। বিচার মিলবে। আমি আমার সাধ্য মতো চেষ্টা করব”।

কিন্তু প্রশ্ন হল, ৭১ দিন পরে কেন তার মুখ থেকে শুনতে হচ্ছে উনি দাবিগুলিই জানেন না! তবে সোমবার জুনিয়ার ডাক্তাররা মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া সময়েই বৈঠকে যাবেন বলে জানিয়েছেন। কারণ সরাসরি তাঁদের মুখ থেকে শুনলে হয়ত ওঁর বুঝতে সুবিধা হবে। আর মুখ্যমন্ত্রীকে জুনিয়র ডাক্তারদের পক্ষ থেকে দেবাশিস হালদার ফোনে বলেন, ‘”আপনি যেসব দাবি মেনে নেওয়ার কথা বলছেন, সেগুলি লিখিতভাবে জানান। একটা ভুল ধারনা তৈরি হয়েছে যে, শুধুই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আমরা অনশন করছি। এমনটা নয়”। আন্দোলনের পরিচিত মুখ দেবাশিস হালদার বলেন, ‘‘যে ভাবে ফোনে কথা হল, তা খুবই অসংবেদনশীল। ওঁরা অনশন তোলানোর জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু যাঁরা অনশনে বসেছেন, এটা তাঁদের সকলের সিদ্ধান্ত। ফলে আলোচনা করেই আমরা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব”। আর এক আন্দোলনকারী আশফাক উল্লাহ নাইয়া বলেন, ‘‘উনি সোমবার সময় দিয়েছেন মানে আরও দু’দিন অনশন চলবে। মনে রাখবেন, অনশনকারীরা শুধু একটা ‘ফোন কল’-এর জন্য জীবন বাজি রাখেনি। তারা শুধু একটা প্রতিশ্রুতির জন্য জীবন বাজি রাখেনি। আমাদের চোখ থাকবে সোমবারের বৈঠকের দিকে”। সোমবারও দাবি না মানা হলে আন্দোলন একই তীব্রতায় জারি থাকবে। রুমেলিকা বলেন, ‘‘আজ শনিবার। আর উনি সোমবার বৈঠক ডেকেছেন। অর্থাৎ, আরও দু’দিন বাধ্য হয়েই চালিয়ে যেতে হবে অনশন। ওঁর কি এক বারও মনে হল না এরা আরও দু’দিন না খেয়ে থাকবে?’’ মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া ঘিরে ক্ষুব্ধ সকলেই। জুনিয়র ডাক্তারেরা বলছেন, ‘‘ওঁর কি মনে হচ্ছে এই অনশনের কোনও গুরুত্ব নেই? যাঁরা আমাদের সঙ্গে রয়েছেন, তাঁদের প্রচেষ্টাকে এত লঘু করে দেখা হচ্ছে কেন? যে ভাবে কাজে ফেরার অনুরোধ করছেন, তা বেদনাদায়ক”।