৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের দেশের সংবাদ মাধ্যম সব না হলেও বেশ কিছু সংবাদপত্র ও বৈদ্যুতিন মাধ্যম যে অতিরিক্ত উৎসাহ ও আগ্রহের সঙ্গে ভুল খবর পরিবেশন করছিল তা নিয়ে খুব বেশি তর্কের অবকাশ নেই। সম্প্রতি এদের মধ্যে অনেকে আবার সংবাদ পরিবেশনকে প্রপাগান্ডা মেশিনে পরিণত করে ফেলেছে। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর আকমনের খবরাখবর দেখে শুনে মনে হচ্ছে সমান্তরাল আরেকটা পৃথিবীতে বাংলাদেশ নামে আরেকট দেশ আছে, যেখানে হিন্দু নিধন যজ্ঞ শুরু হয়েছে এবং হিন্দুদের মেরেকেটে ছারখার করে দেওয়া হচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস তাদের একেবারেই জানা বোঝা নেই। তার মানে এই নয় যে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর, বিশেষ করে হিন্দুদের ওপর কোনো হামলা হয়নি। স্বাধীনতার আগে থেকেই বাংলাদেশে বেশকিছু নাশকতামূলক আক্রমণের শিকার হয়েছে হিন্দু জনগোষ্ঠী।

গত ১২ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ‘প্রথম আলো’র  প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৫ থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত হামলার শিকার সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১ হাজার ৬৮। তবে এর মধ্যে কমপক্ষে ৫০৬টি প্রতিষ্ঠানের মালিক আওয়ামী লিগের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। গত ১৬ বছরে আওয়ামীলিগের দুঃশাসনে অতিষ্ঠ জনগণ নিপীড়কদের সহযোগীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। বাকি অনেকগুলো আক্রমণ আওয়ামী রাজনীতির মদদপুষ্ট হিন্দুদের উপর করা হয়েছে। শুধু হিন্দু হওয়ার কারণে সাম্প্রদায়িক আক্রমণের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। এর আগে বড় ধরনের হামলার ঘটনা ঘটে আওয়ামীলিগ সরকারের আমলে ২০২১ সালে দুর্গা পূজার সময়। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, সে বছর দেশের ২৭টি জেলায় হামলায় ১১৭টি মন্দির-পূজামণ্ডপ ভাংচুর করা হয়। ৩০১টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়িতে হামলা হয়। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে নিহতের চেয়ে ২০২১ সালে নিহতের সংখ্যা বেশি ছিল।

সাম্প্রদায়িক হামলার সময় ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের আগ্রহ বা উৎসাহ তখন মোটেও নজরে আসেনি অথচ ৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশের যে কোনো বিষয়েই ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে আগুন জ্বলছে। এর একটা কারণ হতে পারে যে ভারতীয় মিডিয়ার একটা বড় অংশই মোদির রাজনীতি ও প্রশাসনে প্রভাবিত। ফলে বেশির ভাগ মিডিয়াই মোদির রাজনৈতিক বয়ান প্রচারে ব্যস্ত থাকে। সেই হিসেবে শেখ হাসিনার পতন ঘিরে বাংলাদেশের সমালোচনা মোদির জন্য একেবারেই শুভ নয়। সেই পরিস্থিতি্র ভারসাম্য বজায় রাখতেই সম্প্রতি বাংলাদেশের চূড়ান্ত অব্যবস্থা, ইউনুসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যার্থতাকে হিন্দু নিধনযজ্ঞ বলে ধারাবাহিক প্রচার চালাতে উঠেপরে লেগেছে ‘গদি’ মিডিয়া। ঠিক এই পরিস্থিতিতে ইসকন থেকে বহিষ্কৃত নেতা চিন্ময় দাসকে গ্রেফতার করে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার আগুনে ঘি ঢেলে দিল। এটা পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত কারণ, যে মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে সেটা ধোপে টেকে না। অক্টোবরের ২৫ তারিখে চট্টগ্রামে সম্মিলিত সনাতনী জাগরণী জোটের এক সমাবেশে চিন্ময় বক্তব্য রেখেছিলেন। সেখানে গেরুয়া পতাকা বাংলাদেশের পতাকার উপরে যদি থেকেও থাকে তাতে জাতীয় পতাকাকে অবমাননা করা হয়েছে বলে একটা রাষ্ট্রদোহ মামলা করেন ফিরোজ খান বলে বিএনপির একজন নেতা। মামলা করার সময় ফিরোজ খান বিএনপির থেকে যেমন অনুমতি নেননি, রাষ্ট্রদোহ মামলা করতে গেলে রাষ্ট্রেরও অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু চিন্ময় গ্রেফতার হলেন। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম সেটাকে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচারের নমুনা হিসেবে উপস্থাপন করা শুরু করলো।  

এরপর যখন চিন্ময়কে আদালতে তোলা হলো সেখানেও তাকে জামিন দেওয়া হল না। আদালত প্রাঙ্গণে চিন্ময়ের সমর্থক আর পুলিশের সংঘর্ষ, পরবর্তীতে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ নিহত হলেন। এর দায় অন্তর্বর্তী সরকার এড়াতে পারে না। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম এই হত্যাকাণ্ডে প্রথমেই প্রচার করল যে সাইফুল ইসলাম চিন্ময় দাসের আইনজীবী এজন্য ইসলামী জঙ্গিরা তাকে খুন করেছে। সাইফুল ইসলামকে যে হিন্দু সন্ত্রাসীরা মেরেছে এই খবরটি তারা বেমালুম চেপে গিয়ে প্রচার করলো যে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে সাইফুল ইসলাম নিহত হয়েছেন। এই মিথ্যা প্রচারে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের জে উসকে দেওয়া হল  তা তারা বুঝলো না। হিন্দুত্ববাদীদের পান্ডা বাংলাদেশের সঙ্গে সব অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি জানিয়ে হুমকি দিল যে বাংলাদেশকে তারা ভাতে মারবে। তারা বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্তে বিশাল সমাবেশ করে পণ্য সরবরাহে বিঘ্ন ঘটালো। একদল আগরতলায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে সরাসরি আক্রমণ চালিয়ে নাশকতামূলক ঘটনা ঘটালো। চিন্ময় দাসের গ্রেফতার কিংবা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ খতিয়ে দেখা হল না। উল্লেখ্য, আওয়ামীলিগের আমলে যখন হিন্দুদের উপর নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে তখন আজকের এই নেতাদের কোনো সমাবেশ আয়োজনের কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। আসলে যে কোনো সংঘর্ষের ঘটনাই নিন্দনীয় তা কিন্তু তারা বলছেন না। কেবল একের পর এক হিন্দু সম্প্রদয়াকে উত্তেজিত করে একের পর এক সমাবেশ করে উন্মাদনা সৃষ্টি করে যাতে হিন্দু আর মুসলিমদের মুখোমুখি লাগিয়ে দেওয়া যায় তার জন্য তোরজোড়।

চিন্ময় ইস্যুতে বাংলাদেশ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটা বড় দায় আছে সেটা তারা পালন করেন নি। তাই এক অত্যাচারী নিপীড়ক শাসন শেষ হওয়ার পর আবার নিপীড়কের অস্ত্র ব্যবহার করে মামলা বা গ্রেফতার করা হচ্ছে তার উত্তর পেতেই হবে কারণ, নতুন বাংলাদেশ গড়তে গেলে সব ধর্মের মানুষদের মধ্যে সম্প্রীতি খুব জরুরি। কিন্তু যারা এ সম্প্রীতির পথে ষড়যন্ত্র করছে, সে যে ধর্মেরই হোক না কেন তাকে চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version