এক নজরে

এপাড় ওপাড় লালে লাল

By admin

September 28, 2022

নবদ্বীপের যোগনাথতলার কুমারনাথ ভট্টাচার্যর বাড়িতে একশো কুড়ি বছর ধরে হয়ে আসছে লাল দুর্গার পুজো। ভট্টাচার্য পরিবারের আদি বাড়ি ছিল অবশ্য বাংলাদেশের ঢাকা জেলার মিতরা গ্রামে। সেখানেও পুজো হত লাল দুর্গা। দেশভাগের বহু আগেই ভট্টাচার্য পরিবার মিতরা থেকে যোগনাথতলায় চলে এসেও পূর্বপুরুষদের পুজো  চালিয়ে যাচ্ছেন, ধরে রেখেছেন লাল দুর্গামূর্তির ঐতিহ্য। কিন্তু দেবীমূর্তির রং লাল কেন? ঘটনাস্থল মিতরা, দেবী বন্দনার সময় গৃহকর্তা ছেলেকে পাশে বসিয়ে চণ্ডীপাঠ করছেন। ছেলে বাবার উচ্চারণে ভুল ধরলে ক্রুদ্ধ বাবা ছেলেকেই পাঠ করতে বলেন। ছেলের বিশুদ্ধ উচ্চারণ ও অপূর্ব সুরের চণ্ডীপাঠ শুনে নাকি দেবী দুর্গা এতই প্রসন্ন হন যে দক্ষিণমুখী দুর্গা পশ্চিমমুখী হয়ে যান সেই সঙ্গে তাঁর মুখের আভা আনন্দে লাল হয়ে ওঠে। এরপর থেকেই ভট্টাচার্য বাড়ির দুর্গামূর্তির গায়ের রং লাল হয়ে যায়। নদিয়ার যোগনাথতলার ভট্টাচার্য বাড়ি ছাড়াও লাল দুর্গামূর্তি পুজো হয় কৃষ্ণনগরের নেদেরপাড়ায় চক্রবর্তী পরিবারে। এদের আদি বাড়ি ছিল কৃষ্ণনগর শহরের নগেন্দ্রনগরে। সেখানেই লাল দুর্গামূর্তির পুজো শুরু হয়েছিল। সেই ঐতিহ্য বজায় রেখেছে নেদেপাড়ার বংশধররা।

তাহেরপুরের জমিদার কংসনারায়ণ ১৫৮০ সালে যে দুর্গা পুজোর আয়োজন করেছিলেন সেটাই বঙ্গদেশের প্রাচীন দুর্গাপুজো বলে স্বীকৃত। কিন্তু ১৫৬২ সালে কোচ রাজা নরনারায়ণ সংকোশ নদীর ধারে চামটা গ্রামে যে দুর্গা পুজোর সূচনা করেছিলেন তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সেই দেবী দুর্গার গায়ের রঙও টকটকে লাল; বলা ভাল রক্তবর্ণ, ভয়ালদর্শনা। কথিত, রাজা নরনারায়ন স্বপ্নে এমন দেবীরূপ দেখেই দুর্গা পুজোর সূচনা করেছিলেন। আর সেটাই হল হিমালয় সংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীন দুর্গা পুজো যা কোচবিহারের বড়দেবী বাড়ির দুর্গাপুজো নামে পরিচিত।

এই দুর্গা-মূর্তির রং ও রুপ একেবারেই অন্যরকম। দুর্গা বসে আছেন বাঘের পিঠে। দেবী শান্ত, সৌম নন একেবারেই। ভয়াল দর্শনা দশপ্রহরনধারিণী যেন রক্তে স্নান করে আমাদের দিকেই তেড়ে আসছেন। তাঁর সংসারে লক্ষ্মী, গনেশ, কার্তিক, সরস্বতী নেই, দুপাশে আছেন জয়া ও বিজয়া। পুরনো কোচবিহার থেকে মাত্র এক কিমি দূরে বড়দেবীর মন্দির। সাধারণ মানুষ সপ্তমী থেকে দশমী- এই চারটি দিন তাঁর দর্শন ও তাঁকে নিবেদনের সুযোগ পান। পুজোর অন্যতম অনুষঙ্গ পশুবলি- পায়রা থেকে পাঠা, মোষ, শোল মাছ, শুয়োর; বলি হয় রোজ। একসময় নাকি নরবলি হত। এখন প্রতীকী নরবলি হয়, তবে সাধারণের দেখা নিষেধ। চালের গুঁড়ো দিয়ে আঁকা মানুষ বলি হয়। কিন্তু তাতেও দরকার হয় মানুষের রক্ত। বংশানুক্রমিকভাবে একটি পরিবারের সদস্যরা আঙুল কেটে সেই রক্ত দিয়ে আসছেন।

রক্তবর্ণা বা লাল রঙের দুর্গামূর্তি পুজো হয় জলপাইগুড়ি বৈকণ্ঠপুর রাজবাড়ির পুজোতেও। রক্তবর্ণা দুর্গার হাতে ত্রিশূলের বদলে থাকে শূল বা বল্লম জাতীয় অস্ত্র, সেই অস্ত্র দিয়ে দুর্গা অসুরকে আঘাত করছেন। রায়কত বংশের প্রাচীন মুর্তিতে যদিও কার্তিক, গনেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী কেউ থাকত না। কয়েক বছর ধরে তাদের লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে আগের মতো জয়া, বিজয়া, মহাদেব, ব্রহ্মা, মেছেনিও আছেন। শাস্ত্রে ব্যাঘ্রবাহনা দুর্গার উল্লেখ না থাকলেও রায়কত পরিবারের লাল দুর্গা সিংহের বদলে বাঘের ওপর অধিষ্ঠান করেন। একচালার প্রতিমায় দেবী দুর্গা, লক্ষ্মী, গনেশ, কার্তিক, সরস্বতী ও তাদের বাহনরাও থাকেন। একচালার প্রতিমাটি একটি রথের ওপর বসানো থাকে। রথটি সাধারণত বৈকুন্ঠপুর জঙ্গলের ময়না কাঠ দিয়ে তৈরি হয়ে থাকে। রাজা প্রসূনদেব রায়কত বংশের রীতি অনুসারে কৃষ্ণনগর থেকে মৃৎ শিল্পী এসে মূর্তি নির্মান করেন। বিগত পাঁচশো ধরে এমনটাই হয়ে চলেছে।

তবে বৈকুন্ঠপুর রাজপরিবারের লাল দুর্গা কোচবিহারের বড়দেবী বাড়ির দুর্গার মতো ভয়ংকর নয় কিম্বা সংহার দৃষ্টিতেও চেয়ে থাকেন না। বরং ডিম্বাকৃতি মুখের উজ্জ্বল চোখ দুটি দেখে মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত কোণে তিনি শান্তির বার্তা পৌঁছে দিতে চাইছেন। জটাধারী দেবীর তৃতীয় নয়নটিও উজ্জ্বল; তা থেকেও ঝরে পড়ছে শান্তি। সময় এগিয়ে চলেছে, দ্রুত বদলাচ্ছে চারপাশ, এতকিছুর পরিবর্তনেও প্রাচীন রীতিনীতি বদলের চেষ্টা নেই এই রাজবাড়ির পুজোয়। যতদূর সম্ভব চেষ্টা করা হয় ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখার। আদতে রাজবাড়ির পুজো হলেও বিগত পাঁচশো বছরের বেশি সময় ধরে জলপাইগুড়িবাসীর আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রস্থল বৈকুন্ঠপুর রাজবাড়ির পুজো।