কলকাতা ব্যুরো: গোসাবা, খড়দহ, শান্তিপুর ও দিনহাটা বিধানসভা কেন্দ্রে গত ৩০ অক্টোবর উপনির্বাচন হয়েছে। মঙ্গলবার এই চার কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণা হল। এর মধ্যে নিঃসন্দেহে পাখির চোখ ছিল খড়দহ কারণ এখানে রাজ্যের মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় প্রার্থী হন। যিনি ভবানীপুরে একুশের ভোটে জয়ী হলেও পরে ইস্তফা দেন। দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উপনির্বাচনে লড়বেন বলে তাঁকে সেই আসন ছেড়ে দিতে হয়।

তবে মঙ্গলবার ফলাফল ঘোষণার পর দেখা গেলো চারটি আসনেই তৃণমূল কংগ্রেসের জয়জয়কার। খড়দহ কেন্দ্রের উপ নির্বাচনে জয়ী হলেন তৃণমূল প্রার্থী তথা রাজ্যের কৃষি মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। ৯৩ হাজার ৮৩৮ ভোটে জয়ী হয়েছেন তিনি। পাশাপাশি গোসাবায় রেকর্ড ভোটে জয়ী হয়েছেন তৃণমূল প্রার্থী সুব্রত মণ্ডল। দেড় লক্ষের কাছাকাছি ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন তিনি। দিনহাটাতেও তৃণমূল প্রার্থী উদয়ন গুহর রেকর্ড জয়। এই জয় দেড় লক্ষের বেশি ভোটের ব্যবধানে। শান্তিপুরেও জয়ী হয়েছেন তৃণমূল প্রার্থী ব্রজকিশোর গোস্বামী। ৬৪ হাজার ৪৩৬ ভোটে জয়ী হয়েছেন তিনি। তবে উল্লেখযোগ্যভাবে দিনহাটা ও গোসাবায় বিজেপির জামানত জব্দ হয়।

অন্যদিকে একই রকম গুরুত্বপূর্ণ ছিল দিনহাটা ও শান্তিপুরের ফলাফলও। এই দুই আসনে একুশের ভোটে জয়ী হয় বিজেপি। তবে ভোটে লড়েছিলেন দুই সাংসদ নিশীথ প্রামাণিক ও জগন্নাথ সরকার। পরে দল তাঁদের সাংসদ হিসাবেই রেখে দেয়। ফলে নতুন বিধায়কের প্রয়োজন পড়ে এখানে।

গোসাবা কেন্দ্রটি তৃণমূল জেতে। ঘাসফুলের প্রার্থী হয়েছিলেন জয়ন্ত নস্কর। তবে ভোটের পর করোনা আক্রান্ত হয়ে এই প্রবীণ নেতার মৃত্যু হয়। তাই এই আসনে উপনির্বাচন হয়। একই সঙ্গে খড়দহে জিতেছিলেন তৃণমূলের কাজল সিনহা। তবে তিনিও করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন। তাই উপনির্বাচন। চারটি কেন্দ্রেই জয়ী হল তৃণমূল। গোসাবায় সুব্রত মণ্ডল, দিনহাটায় উদয়ন গুহ, খড়দহে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় এবং শান্তিপুরে জয়ী হন ব্রজকিশোর গোস্বামী।

প্রত্যাশা মাফিকই একুশের বিধানসভা উপনির্বাচনে উত্তর ২৪ পরগনার খড়দা আসনে জয়ী হলেন তৃণমূল প্রার্থী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। নিকটতম প্রতদ্বন্দ্বী বিজেপির জয় সাহাকে ৯৩ হাজার ৮৩২ টি (পোস্টাল ব্যালট-সহ) পরাজিত করেন তিনি৷ তাঁর এই জয় খড়দাবাসীকেই উৎসর্গ করেছেন শোভনদেব ৷ বিধায়কের মতে, তাঁর নামের পাশে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতীক ছিল৷ জয়লাভের জন্য সেটুকুই ছিল যথেষ্ট কারণ, মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে রয়েছে ৷ উপনির্বাচনের ফলাফলই এর প্রমাণ বলে দাবি শোভনদেবের ৷

একইসঙ্গে, এই কেন্দ্রের প্রয়াত বিধায়ক কাজল সিনহার কথা উল্লেখ করতে ভোলেননি তাঁর উত্তরসূরি ৷ শোভনদেব মনে করেন, কাজল সিনহা শুধুমাত্র এলাকার বিধায়ক ছিলেন না৷ তাঁর সঙ্গে এলাকাবাসীর আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল৷ উপনির্বাচনে সেই ভাবাবেগও যে ফ্যাক্টর হয়েছে, তা মানছেন শোভনদেব৷

তবে উল্লেখযোগ্য ভাবে কয়েকদিনের মধ্যেই ভাগ্য বদল হলো উদয়ন গুহর ৷ যে দিনহাটা আসনে তিনি হেরেছিলেন ৫৭ ভোটে, সেখানেই জিতলেন লক্ষাধিক ভোটে ৷ ‘নিশীথ গড়’ ধুলিসাৎ হল সবুজ ঝড়ে ৷ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিকের বুথেই লজ্জার হার হল বিজেপির ৷ জামানত জব্দ হল দলবদলু অশোক মণ্ডলের ৷

তবে দিনহাটায় এবারের উপনির্বাচনের ফলাফলে আরও অনেক রাজনৈতিক হিসেব-নিকেশ বদল ঘটল কারণ, ২০১৬ সাল থেকে ক্রমশ উত্তরবঙ্গে রাজনৈতিক শক্তিবৃদ্ধি হয়েছে গেরুয়া শিবিরের ৷ ২০১৯ সালে কোচবিহার লোকসভা আসন থেকে জেতেন বিজেপির নিশীথ প্রামাণিক। ২০২১ সালে নিশীথকেই দিনহাটায় প্রার্থী করেছিল বিজেপি ৷ সেখানে তিনি ৫৭ ভোটে হারিয়েছিলেন তৃণমূলের উদয়ন গুহকে ৷ ওই নির্বাচনের ফলে কারচুপি হয়েছে বলে বারবার অভিযোগ তুলেছে তৃণমূল৷ কাঠগড়ায় তোলা হয়েছিল নিশীথ প্রামাণিককেই ৷

পরবর্তী সময়ে সাংসদ পদ রেখে নিশীথ দিনহাটার বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন ৷ কেন্দ্রের মন্ত্রীও হয়েছেন৷ কিন্তু উপনির্বাচনে বিজেপি সেই আসন ধরে তো রাখতে পারলই না বরং হারলো ১ লক্ষ ৬৩ হাজার ৫ ভোটে ৷ এমনকী, দিনহাটার ২৩৪ নম্বর বুথে বিজেপি পেয়েছে মাত্র ৯৫টি ভোট ৷ সেখানে তৃণমূল পেয়েছে ৩৬০ টি ভোট ৷ ওই বুথেরই ভোটার নিশীথ প্রামাণিক ৷ ফলে বলাই যায় যে এই হার তাঁর কাছেও বড় ধাক্কা ৷

গোসাবা কেন্দ্রে জয়ী হয়েছেন তৃণমূল প্রার্থী সুব্রত মণ্ডল। ভোটের ব্য়বধানে কার্যত চমক দিয়েছেন তিনি। দেড় লক্ষের বেশি ভোটের ব্য়বধানে জয়ী হয়েছেন সুব্রত। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বিজেপি। প্রথম থেকেই লক্ষাধিক ভোটে জয়ী হওয়ার কথা বলে আসছিল তৃণমূল। তবে ভোটের ব্যবধান যে এত বেশি হবে, তা হয়ত প্রত্যাশা করেনি ঘাসফুল শিবিরও। চার কেন্দ্রেই ভালো ফল করছে তৃণমূল। তবে এই উপ নির্বাচনে কার্যত নায়ক হয়ে উঠেছেন তৃণমূল প্রার্থী সুব্রত মণ্ডল। এলাকায় উচ্ছ্বাসের ছবি চোখে পড়ছে। মূলত সুন্দরবন এলাকার একাংশ এই কেন্দ্রের অন্তর্গত। সাম্প্রতিককালে ঝড়-বন্যার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে এলাকার মানুয। তাই বিধায়ককে ঘিরে তাঁদের অনেক প্রত্যাশা। সুব্রত মণ্ডল এই অঞ্চলেরই বাসিন্দা। তাই তাঁকে ভরসা করেছেন বাসিন্দারা।

গোসাবায় একুশের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের তরফে প্রার্থী হয়েছিলেন জয়ন্ত নস্কর। জয়ীও হন নির্বাচনে। কিন্তু করোনা আক্রান্ত হয়ে এই প্রবীণ নেতার মৃত্য়ু হয়। পরে এই কেন্দ্রে কাকে প্রার্থী করা হবে তা নিয়ে কপালে ভাঁজ পড়েছিল ঘাসফুল শিবিরের। এরপর ভবানীপুরে উপনির্বাচনের ফল ঘোষণার দিন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান গোসাবার প্রার্থী কাকে করা হবে তা পরেই জানানো হবে। তারপরের দিনই তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে জানানো হয়, গোসাবার প্রার্থী হতে চলেছেন সুব্রত মণ্ডল। অন্যদিকে, বিজেপির তরফে প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন পলাশ রানা।

পাশাপাশি এবার শান্তিপুরের জেতা আসনও হাতছাড়া হল বিজেপির। তৃণমূলের ব্রজকিশোর গোস্বামী সেখানে জয়ী হলেন। প্রায় ৩০ হাজার ভোটে হারালেন বিজেপি প্রার্থী নিরঞ্জন বিশ্বাসকে। মঙ্গলবার রাজ্যের চার কেন্দ্র, দিনহাটা, গোসাবা, শান্তিপুর এবং খড়দহে উপনির্বাচনের ভোটগণনা শুরু হয়। তাতে সকাল থেকেই শান্তিপুরে এগিয়ে ছিলেন তৃণমূলের ব্রজকিশোর। বেলা দেড়টা নাগাদ ১৩ রাউন্ড গণনার শেষে দেখা যায়, ৪০ হাজার ৩০০-এর বেশি ভোটে এগিয়ে রয়েছেন তিনি। তার কিছু ক্ষণের মধ্যেই তাঁকে জয়ী ঘোষণা করা হয়।

সদগুরু বিজয়কৃষ্ণ সেবা সমিতির সভাপতি ব্রজকিশোর গোস্বামী। এবারই রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয় তাঁর। তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিরাশ করলেন না তিনি। প্রথম বার ভোটের ময়দানে নেমে বিজেপির জেতা আসন ছিনিয়ে নিলেন। এর আগে, বিধানসভা নির্বাচনে নদিয়ার শান্তিপুর থেকে জগন্নাথ সরকারকে প্রার্থী করে বিজেপি। আসনটি জিতে দলের মুখরক্ষাও করেন জগন্নাথ।

কিন্তু ভোটে জেতার পর সাংসদ পদ রেখে বিধায়ক পদটি ছেড়ে দেন তিনি। যে কারণে ওই আসনে উপনির্বাচন করায় নির্বাচন কমিশন। তবে মানুষ তাঁদের নিরাশ করবেন না বলে আশাবাদী ছিলেন নির্বাচনী পর্যবেক্ষকের দায়িত্বে থাকা জগন্নাথ। বলেছিলেন, আমাদের কাছে প্রার্থী বড় বিষয় নয়। শান্তিপুরের মানুষ শান্তি বজায় রাখতে বিজেপিকে ভোট দেবেন।

কিন্তু জগন্নাথের সেই আশাপূরণ হল না। বিধানসভা নির্বাচনে তিনি যেখানে ১৬ হাজার ভোটে জয়ী হয়েছিলেন, মঙ্গলবার তাঁর প্রায় দ্বিগুণ বেশি ভোট পেয়ে জয়ী হলেন ব্রজকিশোর। প্রথম বার ভোটের ময়দানে নেমেই বিজেপির জেতা আসন ছিনিয়ে নিলেন তিনি। তাঁর সামনে টিকতে পারেননি কংগ্রেস প্রার্থী রাজু পাল এবং সিপিএমের সৌমেন মাহাতোও।

এদিন জয় নিশ্চিত হওয়ার পর তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী ব্রজকিশোর গোস্বামী সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বলেন, এই জয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয়, এই জয় উন্নয়নের জয়। তিনি আরও জানান, সাধারণ মানুষ উন্নয়নের পক্ষে রায় দিয়েছেন। এই জয় শান্তিপুরবাসীর জয়। আগামীদিনে কীভাবে শান্তিপুরে আরও উন্নয়ন করা যায় সেই বিষয়ে নজর রাখবো।

প্রসঙ্গত, যে চার আসনে উপনির্বাচন হয়েছে, সেখানে তৃণমূল ও বিজেপির বিধায়ক সংখ্যা ২-২ ছিল ৷ গোসাবা ও খড়দহ তৃণমূলের দখলে ছিল ৷ আর বিজেপি জিতেছিল দিনহাটা ও শান্তিপুর আসনে ৷ কিন্তু এবার সেই ফলাফল একেবারে উল্টে গেল ৷ তৃণমূলের দখলেই চলে গেল সবক’টি আসন ৷

এর ফলে বিধানসভায় বিধায়ক সংখ্যা বাড়ল তৃণমূলের ৷ আর ৭৭ থেকে কমে সরকারিভাবে ৭৫ হল বিজেপি ৷ আর তৃণমূলের হাতে এখন ২১৫ জন বিধায়ক হল ৷ তবে বিজেপি থেকে তৃণমূলে চলে গিয়েছেন আরও পাঁচজন বিধায়ক ৷ ফলে খাতায় কলমে বিজেপির বিধায়ক এখন ৭৭ হলেও আসলে গেরুয়া শিবিরে রইলেন আর মাত্র ৭০ জন বিধায়ক৷

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version