কলকাতা ব্যুরো: বৃহস্পতিবারের হাইভোল্টেজ কেন্দ্র ভবানীপুর। প্রার্থী খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উপনির্বাচনে এই কেন্দ্রে প্রার্থী দেয়নি কংগ্রেস। কিন্তু বিজেপি এবং বামেরা প্রার্থী দিয়ে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে রাজ্যের শাসক দলকে। আইনজীবী প্রিয়াঙ্কা টিব্রিওয়ালকে দিয়ে বাজিমাত করার পরিকল্পনা করছে বিজেপি। এদিকে এই কেন্দ্রে সিপিআইএম-এর মুখ শ্রীজীব বিশ্বাস। এদিন সকাল থেকেই দেশের নজর ভবানীপুরের উপর। কত শতাংশ ভোট পড়লো? নির্বিঘ্নে ভোটাভুটি সম্পন্ন হচ্ছে কি না? সবকিছু জানতে সকাল থেকেই টিভির পর্দায় চোখ রেখেছে দেশ তথা রাজ্যবাসী। তবে এদিন দুপুর ৩টে পর্যন্ত ৫০ শতাংশও ভোট পড়লো না ভবানীপুরে। কমিশনের রিপোর্ট জানাচ্ছে দুপুর ৩টে পর্যন্ত এই কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৪৮.০৮ শতংশ। সামশেরগঞ্জে ভোট পড়েছে ৭২.৪৫ শতাংশ। জঙ্গিপুরে এই পরিসংখ্যান ৬৮.১৭ শতাংশ।

উল্লেখ্য, জমা জলে ভোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছুটা চিন্তিত ছিল রাজ্য প্রশাসন, কলকাতা পুরনিগম ও পুলিশের উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা। বুধবার বেলার পর থেকে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হতেই যুদ্ধকালীন তৎপরতায় শুরু হয় জল নামানোর কাজ। তবে রাত অবধি কাজ চালিয়ে কিছুটা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। তবে এখনও ভবানীপুর তথা শহর কলকাতার একাধিক জায়গায় জল জমে আছে বলে খবর। অন্যদিকে আজ ভবানীপুরে উপনির্বাচনের পাশাপাশি নজরে মুর্শিদাবাদের দুই কেন্দ্রের উপনির্বাচন। তবে এদিন এখনও পর্যন্ত মোটের উপর ভোট শান্তিপূর্ণ হচ্ছে। বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ছাড়া ভোট নির্বিঘ্নেই হচ্ছে বলা চলে।

এদিকে অশান্তি এড়াতে ভবানীপুরের সব বুথে ১৪৪ ধারা জারি করেছে নির্বাচন কমিশন। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকেই জারি হয়েছে এই নির্দেশিকা। বৃহস্পতিবার মধ্যরাত পর্যন্ত এই নির্দেশ বজায় থাকবে। এদিন ভোট মিটে গেলেও মধ্যরাত পর্যন্ত ভবানীপুর এলাকায় পাঁচজনের বেশি জমায়েত করা যাবে না। এই কেন্দ্রে মোতায়েন রয়েছে ৩৫ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী। নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলা হয়েছে গোটা এলাকা। কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে লালবাজারও। কেন্দ্রীয় বাহিনীর পাশাপাশি ভবানীপুরের সুরক্ষায় মোতায়েন রয়েছে কলকাতা পুলিশ। ভবানীপুরে রয়েছেন পাঁচজন জয়েন্ট সিপি পদমর্যাদার আধিকারিক। ১৪ জন ডেপুটি কমিশনার ও ১৪ জন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার। ভবনীপুর বিধানসভা কেন্দ্রের জন্যই মোতায়েন রয়েছে দুই কোম্পানি বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী।
এদিন ভবানীপুরের ৭০ নম্বর ওয়ার্ডের শরৎ বোস রোডের একটি বুথে ছাপ্পা ভোটের অভিযোগ ওঠে। মাস্ক পরে দু’জন ভুয়ো ভোটার ঢুকেছিল বলে অভিযোগ বিজেপির। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছন বিজেপি নেতা কল্যাণ চৌবে ও সিপিআইএম প্রার্থী শ্রীজীব বিশ্বাস। পরে কেন্দ্রীয় বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এদিন ভবানীপুরে বিজেপি নেতা কল্যাণ চৌবের গাড়িতে হামলার অভিযোগ ওঠে। ডায়সেশন স্কুলে ১৬০ নম্বর বুথের বাইরে বিজেপি নেতার গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগ ওঠে। অন্যদিকে ভুয়ো ভোটারকে কেন্দ্র করে তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে ভবানীপুরের খালসা হাইস্কুলে। বিজেপির অভিযোগ, এক যুবক কোনওরকম কাগজপত্র ছাড়াই ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে ঢুকে ভোট দিচ্ছিলেন। অভিযুক্তকে হাতনাতে ধরে বেধড়ক মারধর করা হয় বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা। তৃণমূলের দাবি, ওই যুবকের কাছে নির্দিষ্ট কাগজ ছিল। অভিযুক্ত জানিয়ছেন, প্রাক্তনী বলে স্কুলে এসেছিলেন।

প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার এদিন সকাল ৬টা থেকে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন বিজেপি প্রার্থী প্রিয়াঙ্কা টিব্রিওয়াল। বুথে বুথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি। এদিন সকালে একবালপুরের একটি বুথে যান প্রিয়াঙ্কা। তাঁর অভিযোগ, বহিরাগত আনিয়ে ভোটে গণ্ডোগোল পাকানোর চেষ্টা করছে তৃণমূল। তবে ভোটের শতাংশ বাড়লে তা আমাদের পক্ষেই যাবে বলেই মত বিজেপি প্রার্থীর।
অন্যদিকে এদিন ভবানীপুরের ১২৬ নম্বর অস্থায়ী বুথে বুথজ্যামের অভিযোগ তোলেন প্রিয়াঙ্কা টিব্রিওয়াল। তাঁর অভিযোগ, মদন মিত্রের এলাকা বলে সেখানে ভোট শুরু করতে অনেক দেরি হয়। পাশাপাশি কারচুপিরও অভিযোগ তোলেন টিব্রিওয়াল। তবে প্রিয়াঙ্কার অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তারা জানিয়েছে, ভবানীপুরের ১২৬ নম্বর বুথে মকপোলের জন্য ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হতে দেরি হয়েছে। কোনও অশান্তি হয়নি।
তবে প্রতিকুল আবহাওয়াতেই সকাল থেকেই ভোটারদের লম্বা লাইন চোখে পড়েছে জঙ্গিপুর ও সামশেরগঞ্জে। ভোটের লাইনে মহিলাদের ভিড়ই বেশি। এদিন সকালে সামশেরগঞ্জ বিধানসভার প্রতাপগঞ্জ অঞ্চলের ১৭৫ নম্বর বুথে EVM খারাপ হওয়ায় ভোটগ্রহণ কিছুটা দেরিতে শুরু হয়। অন্যদিকে বুধবার মধ্যরাতে সামশেরগঞ্জের ঘনশ্যামপুরে তৃণমূল কর্মীর বাড়িতে বোমাবাজির অভিযোগ তোলেন তৃণমূল প্রার্থী আমিরুল ইসলাম। বুধবার মধ্যরাতে কংগ্রেস প্রার্থী জইদুর রহমানের নেতৃত্বেই এই হামলা হয়েছে বলে অভিযোগ। তবে সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কংগ্রেস প্রার্থী। গোটা ঘটনায় রিপোর্ট তলব করেছে নির্বাচন কমিশন। তবে সামশেরগঞ্জে বোমাবাজির অভিযোগে আটক জেলা পরিষদের স্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ বিপ্লব হক। বিপ্লব হক তৃণমূল প্রার্থীর বিরুদ্ধ গোষ্ঠী হিসাবেই পরিচিত। এছাড়া এদিন নকল ইভিএম নিয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করার অভিযোগ ওঠে সামশেরগঞ্জে। তৃণমূলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ভোট গ্রহণ কেন্দ্রের ২০০ মিটারের মধ্যে তৃণমূল প্রার্থীর সমর্থনে ক্যাম্প খুলে নকল ইভিএম দিয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয়। তৃণমূল প্রার্থী আমিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে লাইনে ভোটারদের প্রভাবিত করার অভিযোগও উঠেছে। দুটি ঘটনায় কমিশনে অভিযোগ দায়ের হয়েছে।
পাশাপাশি বৃহস্পতিবার সকালে ১৪৪ ধারা থাকা সত্ত্বেও কেন তা লঙ্ঘন করে রেস্তোরাঁ খোলা? প্রশ্ন তুলে পুলিশদের দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলেন বিজেপি প্রার্থী প্রিয়াঙ্কা টিব্রিওয়াল। এদিকে, বাম প্রার্থী শ্রীজীব বিশ্বাস বলেন, মানুষের রুজি-রুটির বিষয়টিও রয়েছে এ ক্ষেত্রে। গায়ের জোরে দোকানপাট বন্ধ করা উচিত নয়। তবে, ভোটের কারণে কিছু বিধিনিষেধ তো থাকেই। সেটি কমিশনের খতিয়ে দেখা উচিত।
তবে রাজনীতির লড়াই থাকলেও কোনও এক জায়গায় মিলে গেলো সব রাজনীতির রং। ভবানিপুরে দেখা গিয়েছে তেমনই ছবি। এদিন কর্মীদের নিয়ে চায়ের আসর জমালেন ফিরহাদ হাকিম। চায়ের কাপ হাতে বললেন, ‘আরে আমরা পাড়ার ছেলে। ছোট থেকে বন্ধু। আমার বাবা, ওঁর বাবাও বন্ধু। রাজনৈতিক মতাদর্শ আলাদা হতেই পারে। তাবলে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ব্যক্তিগত সম্পর্কের জায়গায়।’

পাশাপাশি নজির গড়েছে জঙ্গিপুরও। ভোটের দিন বুথ পরিদর্শন সেরে ফেরার পথে বিজেপি প্রার্থী সুজিত দাসের মুখোমুখি হন তৃণমূল প্রার্থী জাকির হোসেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময়ের অন্য চিত্র প্রত্যক্ষ করে রাজ্য তথা জঙ্গিপুরবাসী। তবে এদিন সামশেরগঞ্জে ধূলিয়ান পুরসভার ২০ নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী কাউন্সিলর তথা তৃণমূলের কো-অর্ডিনেটের হাবিবুর রহমান ওরফে জোহরকে লাথি মারার অভিযোগ ওঠে কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে।
প্রসঙ্গত, এদিন ফিরহাদ হাকিম ও সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে কমিশনে নালিশ জানায় বিজেপি। ফেসবুক পোস্ট করে ভোটারদের প্রভাবিত করার অভিযোগ তোলা হয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে। দুই মন্ত্রীকে অবিলম্বে নজরবন্দি করার দাবি জানায় গেরুয়া শিবির।