একথা ঠিক যে মুঘল সম্রাটদের মধ্যে কেবলমাত্র আলমগীর আওরঙ্গজেবই অন্যান্য মুঘল সম্রাটদের মতো জনপ্রিয়তা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তাঁর প্রায় পঞ্চাশ বছরের শাসনকালে তিনি একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান বা ধর্মীয় গোঁড়া ব্যক্তি হিসেবেই পরিচিত হয়েছিলেন। একই সঙ্গে তিনি হিন্দুদের ঘৃণা করতেন এবং নিজের রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য নিজের বৃদ্ধ পিতাকে আগ্রার একটি দুর্গে তাঁর জীবনের শেষ সাড়ে সাত বছর বন্দী করে রেখেছিলেন ও নিজের বড় ভাই দারা শিকোহ’কে পর্যন্ত রেহাই দেননি। আচার্য যদুনাথ সরকার পাঁচ খণ্ডে “হিস্ট্রি অফ আওরঙ্গজেব” রচনা করেছিলেন, তাঁর আগে আরও দু’জন আওরঙ্গজেব সম্পর্কে লিখেছিলেন, প্রথমজন ঈশ্বরদাস নাগর যিনি সপ্তদশ শতাব্দীতে ফুতুহাত-এ-আলামগিরি লিখেছিলেন এবং স্বয়ং আওরঙ্গজেব তাকে পুরস্কৃত করেছিলেন; দ্বিতীয়জন ছিলেন ভীমসেন বুরহানপুরী, যিনি আওরঙ্গজেবের মনসবদার হিসেবে লেখা নুসখা-ই-দিলকুশার লেখক।

১৯৪৬ সালের প্রকাশিত জওহরলাল নেহরু তাঁর ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’তে আওরঙ্গজেবকে একজন গোঁড়া ব্যক্তি হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন।অন্যদিকে আমেরিকান ইতিহাসবিদ অড্রে ট্রাশকা তাঁর বই ‘আওরঙ্গজেব- দ্যা ম্যান অ্যান্ড দ্যা মিথ’ বইতে লিখেছেন যে আওরঙ্গজেব হিন্দুদের ঘৃণা করতেন একথা অনেকাংশে সত্য কিন্তু আওরঙ্গজেব মন্দির ধ্বংস করেছেন বলে যে দাবী করা হয় তা সম্পূর্ণভাবে সত্য নয়। অড্রে ট্রাশকা লিখেছেন, ব্রিটিশদের শাসনের সময় তাদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ অর্থাৎ জনগোষ্ঠীকে ‘বিভাজন আর শাসন করো’ নীতির আওতায় ভারতে হিন্দু বর্ণবাদী ধারণা উস্কে দেওয়ার কাজটি করেছিলেন যেসব ইতিহাসবিদরা, তারাই মূলত আওরঙ্গজেবকে এইভাবে উপস্থাপন করার জন্য দায়ী। ষষ্ঠ মুঘল সম্রাট দেড় কোটি মানুষকে প্রায় ৫০ বছর ধরে শাসন করেছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে মুঘল সাম্রাজ্য সব থেকে বেশি বিস্তৃত হয়েছিল, বলা যায় যে প্রায় পুরো উপমহাদেশ তাঁর শাসনের করায়ত্ত হয়েছিল।

অড্রে ট্রাশকার মতে, এটা একটা ভুল ধারণা যে আওরঙ্গজেব হাজার হাজার হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। তবে একথাও ঠিক যে বিশাল সাম্রাজ্যের সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা চালাতে বেশ কয়েকটি মন্দির তাঁর আদেশে ভাঙা হয়েছিল। তবে তাঁর সময়ে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যাকে হিন্দুদের গণহত্যা হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে। বরং সঠিক অর্থে আওরঙ্গজেব হিন্দুদেরকে তাঁর সরকারের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল করেছিলেন। কেবল তাই নয় পুরন্দরের যুদ্ধে আওরঙ্গজেবের সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হিন্দু রাজপুত মির্জা রাজা জয় সিং, তাঁর প্রধান দেওয়ান ছিলেন একজন হিন্দু, রাজা রঘুনাথ রায়, যাঁকে আওরঙ্গজেব তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রশাসক হিসাবে বর্ণনা করেছেন, আওরঙ্গজেবের শাসন আমলে মুঘল প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে হিন্দুদের অংশগ্রহণ ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। ১৬৭৯ সালে, আওরঙ্গজেবের প্রায় ৭২ জন রাজপুত এবং ৯৬ জন মারাঠা মনসবদার ছিলেন। তবে এটাও ঐতিহাসিক সত্য যে আওরঙ্গজেব ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করতে হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছিলেন এবং হিন্দু ব্যবসায়ীদের উপর কর বাড়িয়েছিলেন। আবার ১৬৫৪ সালের একটি লিখিত দলিলে পাওয়া যাচ্ছে তিনি একজন হিন্দু রাজপুত রাজাকে একটি রাজকীয় আদেশ পাঠিয়ে সব ধর্মের জন্য শান্তি ও সমৃদ্ধির কথা বলেছিলেন এবং উপাসনালয় ধ্বংসের সমালোচনা করেছিলেন। ১৬৫৯ সালে আওরঙ্গজেবের নির্দেশ ছিল, বেনারাসে কোনও হিন্দু বা ব্রাহ্মণকে ক্ষতি না করার। ১৬৮৭ সালে নির্দেশ দিয়েছিলেন বেনারাসে ব্রাহ্মণ ও ফকিরদের জন্য বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়ার।

ইতিহাসবিদ ক্যাথরিন ব্রাউন ‘আওরঙ্গজেব কি সঙ্গীতের ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন?’ শীর্ষক একটি নিবন্ধতে উল্লেখ করেছেন যে আওরঙ্গজেব একবার তাঁর এক আত্মীয়ার সঙ্গে দেখা করতে বুরহানপুর গিয়েছিলেন। আর সেখানেই তিনি তাঁর ভালোবাসার মানুষ হিরাবাঈ জাইনাবাদীকে খুঁজে পেয়েছিলেন। কে ছিলেন তিনি? হিরাবাঈ ছিলেন একজন গায়িকা ও নৃত্যশিল্পী। আওরঙ্গজেব তাঁকে প্রথম দেখেছিলেন একটি গাছ থেকে আম পারার সময়ে। তাঁকে দেখে আওরঙ্গজেব এতটাই দিওয়ানা হন যে তিনি মদ না খাওয়ার প্রতিজ্ঞা ভাঙতেও সেই মূহুর্তে রাজী ছিলেন। তবে আওরঙ্গজেব যখন মদের গ্লাসে চুমুক দিতে যাচ্ছেন, ঠিক সেই সময়ে হিরাবাঈ তাকে থামান। তাঁদের এই প্রেম কাহিনী মাত্র এক বছরের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় হীরাবাঈয়ের মৃত্যুর সঙ্গেই।

জীবনের শেষ দিনগুলো আওরঙ্গজেব কাটিয়েছেন ছোট ছেলে কামবাখশ-এর মা উদয়পুরীর সঙ্গে। উদয়পুরী ছিলেন একজন সঙ্গীত শিল্পী। মৃত্যুশয্যায় কামবাখশের কাছে লেখা এক চিঠিতে আওরঙ্গজেব লিখেছিলেন যে রোগে-শোকে উদয়পুরী তাঁর সঙ্গে আছেন, মৃত্যুর সময়ও তাঁর সঙ্গে থাকবেন। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর মাত্র কয়েক মাস পরেই ১৭০৭ সালের গ্রীষ্মকালে উদয়পুরীর মৃত্যু হয়। ভারতীয় ইতিহাসের একটি বড় প্রশ্ন হলো কট্টর আওরঙ্গজেবের বদলে যদি উদারপন্থী দারা শিকোহ ৬ষ্ঠ মুঘল সম্রাট হতেন, তাহলে কী হত? বাস্তবতা হল মুঘল সাম্রাজ্য পরিচালনা করার ক্ষমতা কি দারা শিকোহ’র ছিল না। ভারতের সিংহাসন নিয়ে চার ভাইয়ের মধ্যে যখন প্রতিযোগিতা চলছিল, তখন অসুস্থ্য সম্রাটের সমর্থন ছিল দারার প্রতি। কিন্তু আওরঙ্গজেবের মতো রাজনৈতিক প্রজ্ঞা তাঁর ছিল না।তার থেকেও বড় কথা আওরংজেব মারা গিয়েছেন তিনশো বছর আগে, আজ ফের কেন তাঁকে ঘিরে বিতর্ক।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version